Skip to main content

বাঙালি সব সময়েই দ্বিধাকূল জাত। সৌমিত্র, না উত্তম; সত্যজিৎ, না ঋত্বিক; রবিশঙ্কর, না নিখিল ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু চপ না চিতা? কি নিয়ে খিল্লি হবে, এ এক জটিল ধাঁধায় আজ বাঙালিকূল। এমনিতে দেশে খুব একটা কলকে আজকাল আমরা পাই না। সাহিত্য-সংস্কৃতি সব পশ্চিমে দক্ষিণে গড়াচ্ছে। মায় রাজনীতিতেও দেশের মাটিতে বেশ একটা বলিয়ে কইয়ের জায়গায় নেই। অনেকেই দেখি আনন্দবাজার, এই সময় — এইসবের অনলাইন ভার্সানে গিয়ে তলায় ফুট কেটে আসেন। কিন্তু ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস, ইণ্ডিয়া টুডে ইত্যাদিতে খুব একটা উপস্থিতি দেখা যায় না। আসলে আমরা আমাদের নিয়ে একটা আস্ত সংশয়ে ভুগছি। খুব একটা স্বস্তির জায়গায় নেই। একের পর এক কেলেঙ্কারি রাজ্যজুড়ে বেরোচ্ছে। তায় বিকল্প ভাবার জায়গাতে কেউ দাঁড়ায়নি। এখন করে তো করে কি বাঙালি?

বাঙালি জানে সে চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। সে চাইলে নোবেল পেতে পারে, চাইলে অস্কার পেতে পারে, চাইলে গ্র‍্যামি পেতে পারে। জাতীয় পুরষ্কার তো জলভাত। কিন্তু হচ্ছে না কেন? অবশ্যই ষড়যন্ত্র তো আছেই দেশের, দশের। তা ছাড়া বাঙালি জ্যোতিষেও বিশ্বাসী। সময় হলেই হবে।

তো এ হেন উচ্চগ্রামে বাঁধা যে জাতের সুর, সে জাতের কানে যখন কাঁচা বাদাম, টুনির মা, টুম্পাসোনা আসে, তখন সে কি করে? তখন সে নাচে-গায়। গালাগাল দেয়। সংস্কৃতির দফারফা হল বলে, কিন্তু বারবার শোনে। বারবার রিলে দেখে। আর বলে, এ সবও হচ্ছে!

আবার দ্বিধায় পড়ে বাঙালি। স্রোতে ভাসবে, না প্রতিকূলে সাঁতরাবে। উচ্চগ্রামে উড়ে উড়ে বেড়াবে, না মাটি-কাদা মেখে রাস্তায় নামবে। এত দ্বিধা এত দ্বিধা! যাকে মুখে নিন্দা করি, কাগজে-কলমে নিন্দা করি, প্রাণে প্রাণে তাকেই শ্রদ্ধা করি, তার যা কিছুকে ঈর্ষণীয় ভাবি, অনুকরণীয় ভাবি। এদিকে যে আদর্শ, যে ভাবকে মুখে মুখে, কাগজে-কলমে, বক্তৃতায়-আলোচনায় মুখরিত করে তুলি, তাকেই মনে প্রাণে জানি অকাজের, অচল, মানহীন, অকিঞ্চিৎকর হিসাবে।

দ্বিধা যত আমাদের আঁকড়ে ধরতে চায়, আমরা তত হড়বড় করে, তরতরিয়ে আমাদের সোচ্চারে ঘোষণা করতে চাই। নিজেকে নিয়ে যে আমাদের কোনো সংশয় নেই সেটা বোঝানোর জন্য আশু কোনোদিকে ঝুঁকে পড়ে অন্যদিকের গুষ্টির পিণ্ডি চটকাতে থাকি। ভাবি এইটাই আমার সব চাইতে বড় কাজ।

এখন দ্বিধাকে জয় করতে যে আত্মবিশ্লেষণের দরকার, তার সময়, সুযোগ কই? সোশ্যাল মিডিয়া রেডিমেড উত্তর দিয়ে দিচ্ছে দিনে-রাতে। সেদিন শুনলাম মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, এতদিন মুম্বাই এগিয়েছিল, আজ আমরা বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। আমি মাইকে শুনতে শুনতে উৎসের কাছে গিয়ে দেখি বিরাট করে গণেশ পুজোর উৎসবের আয়োজন। অর্থাৎ, আমরা মুম্বাইকে ধরতে পেরেছি। উল্টোটা কিন্তু কোনোদিন হবে না। মুম্বাই শারদোৎসবকে পাড়ায় পাড়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু ভাববে না। কারণ আজকের বাঙালি তাদের অনুকরণের যোগ্যতাও হারিয়েছে।

মানুষ ভাষা হারাতে শুরু করলে নিজের অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে। নিজের মধ্যে সংকর অবস্থা উৎপন্ন হয়। সংশ্লেষ আর সংকর অবস্থার মধ্যে ফারাক অনেক। সংশ্লেষিত হয় বোধ-বুদ্ধি-উদ্যম-আত্মশক্তির জোরে। আর সংকর উৎপন্ন হয় দুর্বলতা, হীনমন্যতা আর ক্লীবতাকে আশ্রয় করে। আমরা বৈচিত্র বলতে যা বুঝি আজকাল সে দড়কাঁচা সংকর অবস্থা ছাড়া কিছু নয়। পাত্র হারালে যেমন পাত্রস্থ সব কিছুই হারিয়ে যায়, কিম্বা অন্য পাত্রস্থ করলে যেমন সে পাত্রের রঙ, গন্ধ মিশে এক বিদঘুটে জিনিস তৈরি হয় --- আমাদেরও সেই অবস্থা। আমাদের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ সব কিছুই ভীষণ স্থূল। কারণ দ্বিধার ভিতর দিয়ে তাকে অতিক্রমের পথ না পেলে অলস, তামস হাসি-তামাশায় সে সমস্যাকে আশু ভুলে তো থাকা যায়।

মূল কথা হল আমাদের ভাষাটা আমরা অনেক যত্ন করে, অনেক গুরুত্ব দিয়ে হেলায় হারিয়েছি। কোনো মারকাটারি দল তৈরি করে গায়ের জোরে তাকে বাঁচানো যাবে না। কারোর গলায় পাড়া দিয়ে তাকে বাঙলা বলিয়ে হেনস্থা করে নিজের দুর্বলতাকে আরো নগ্ন করে দেখাতে পারি মাত্র, কিন্তু শেষে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করে তুলি।

আমরা আমাদের ভাষার উপর শ্রদ্ধা হারিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয় থেকে তাকে আগাছার মত তুলে ফেলেছি। শ্রদ্ধা ছাড়া চিত্তে কোনো কিছু স্থায়ী হয় না। গতিশীল হয় না। আমরা সেই শ্রদ্ধাকে তিলে তিলে নষ্ট করেছি। শ্রদ্ধার অভাব যত বেড়েছে, আমাদের বাইরের আস্ফালন তত বেড়েছে, উগ্র হয়েছে। আমাদের অধঃপতনের বেগ আরো দ্রুত হয়েছে। আমরা "মধ্যমেধা" শব্দের ঘাড়ে সবটুকু দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছি। এ যেন সূর্য বলছে, এত এত তারা আকাশ জুড়ে উঠেছে যে আমার আলোটা কারোর চোখেই পড়ছে না! হা ভাগ্য! কোথায় এসে আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি দাঁড়িয়েছে! মধ্যমেধা চিরটাকাল আছে। থাকবেও। তাদের সংখ্যাই সব দেশে, সব কালে গরিষ্ঠ। কিন্তু তারা কখনও উচ্চমেধার উৎকর্ষের বাধা হতে পারেনি। হয়ও না।

দোষটা মধ্যমেধার নয়। দোষটা আবারও বলছি, আমরা আমাদের ভাষার উপর স্বাভাবিক শ্রদ্ধাকে হারিয়েছি। তাই সে ভাষাকে জড়িয়ে যা কিছু আমাদের হাত থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা দ্বিধান্বিত হচ্ছি। এই দ্বিধাবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসের আগের অবস্থা। এই আসল-নকল একসঙ্গে নিয়ে চলার চাতুরী, আত্মশ্রদ্ধার শেষ ধাপের ইঙ্গিত। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কি। জানি না আমরা ভারতে দ্বিতীয়, কি তৃতীয় শ্রেণীর অধিবাসী হয়ে থাকব কিনা! সম্পূর্ণ সত্তা বিসর্জন নিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাব কিনা একটা অন্য জাতে! হয়ে গেছিও হয় তো অনেকটা। নাকি আবার কেউ আসবে। নাকি আবার আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঘুরে দাঁড়াব। নচিকেতার মত বলব, না তো আমি সর্বোচ্চ, না তো আমি সর্ব নিকৃষ্ট, আমি আমিই। আমার শ্রদ্ধা আমার ভাষার উপর ফিরিয়ে দেবে সে। আমার ভাষাকে নিয়ে যাবতীয় যা কিছুকে আমি প্রাসঙ্গিকতায় দেখতে শুরু করব আবার। আমি আবারও বলতে পারব যে আমারও এই মহাযজ্ঞে কিছু দেওয়ার আছে যা আমারই ভাষায় জন্মেছে, ধার বা নকল করে আনিনি!

জানি না কি হবে। কিন্তু যা হচ্ছে তা যে ভীষণ ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে!