Skip to main content

 

001.jpg

কাশীতে কবীরের উপর নভেম্বর মাসে একটা আলোচনা, গান ইত্যাদির আয়োজন হয় ইউটিউবে দেখলাম। আরো মজার জিনিস যেটা দেখলাম সেখানে বসতে গেলে, নিতম্ব পিছু মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা করে ধার্য করেছেন উদ্যোক্তারা। অবশ্যই করা উচিৎ। কবীরের মূল্য নেই? তার বাণীর মূল্য নেই? যেখানে এত এত পণ্ডিত মানুষ কবীরের বাণীকে এমন এমন খেতাব দিয়ে রেখেছেন, মায় রবীন্দ্রনাথ অবধি, তাঁর বাণীর মূল্য নেই? দিব্যি আছে।

আমার ঘরে খানকয়েক কবীরের বই আছে। তার সব মিলিয়ে মূল্য হাজার খানেকও ছোঁবে না। আমি পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে মাঝে মাঝে দেখি। আবার বন্ধ করে রেখে দিই। বই খোলার আগের আমি আর বই বন্ধ করার পর আমি - এ দুয়ের মধ্যে কোনো ফারাক রাখার ঝঞ্ঝাটের মধ্যে আমি যাই না। ওনারাও যান না। কারণ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বেশ কয়েকজন “হস্তি”কে দেখলাম, তারা বছরের পর বছর একই থেকে গেছেন। অর্থাৎ চল্লিশ হাজার টাকায় উদর আর নিতম্বের আরামদায়ক অভিজ্ঞতা ছাড়া আর তেমন কিছু তেনাদেরও হয়নি এ বোঝা যায়।

যাক গে, ছোটো মুখে বড় কথা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উন্নত চরিত্র গঠনের আশায় আমিও যে এককালে ঘুরিনি তা তো নয়। কত সাধুসন্ত, সৎসঙ্গ করলাম। বুঝলাম ওঁদের বাণীর অন্ত নেই, কিন্তু আমার উন্নত হওয়ার সম্ভাবনার একটা সীমা আছে। একদিন হার মানলাম। কিন্তু সেই সব বিলাসবহুল না হলেও, বিলাসহীন তো একেবারেই নয়, এমন ব্যবস্থায় নানা আশ্রমে ঘুরে তো বেড়িয়েছি। গৃহী ও সন্ন্যাসী কারোরই পার্থিব সুখসাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব নেই সেখানে। আমরা বাঙালিরা যতই অধ্যাত্মতত্ত্ব প্রবণ হই না কেন, আমরা বাস্তববোধটা বাদ দিয়ে ওসব করি না। দেখবেন গুরুকে দেখতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছে, কী কোনো সৎসঙ্গে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছে, এসব খবর আমাদের এখানে তেমন শোনা যায় না। ওসব ইউপি, হরিয়ানা, বিহার, ছত্রিশগড়, দক্ষিণের কিছু কিছু জায়গায় হয়। আমরা আগে দেখে নিই পার্থিব সুখসাচ্ছন্দ্যের দিকটা। তারপর কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ, জীবন পদ্মপাতায় জলের মত টলটলে এসব কথা শুনি। শুনতে শুনতে আমোদে চোখ জুড়িয়ে আসে। আর বক্তা যদি বিলেত ফেরত সন্ন্যাসী হয় তবে তো কথাই নেই। মনে হবে মোক্ষ আমার কানের কাছে উড়ন্ত মশা, ঘুরছে আর বলছে, তুই মুক্ত…মুক্ত…মুক্ত…। আমরা শুনতে শুনতে ভাবজগতে বিবেকানন্দ, মহাপ্রভু হয়ে উঠি। বাণী শেষ হয়। আমরাও আসন ছেড়ে উঠি। আবার স্বস্তিতে ফিরে আসি। ভাগ্যে মুক্ত হইনি! আমাদের শোনায়, বলায় আর করায় যে মেলবন্ধনের প্রতিশ্রুতি থাকতেই হবে, এমন কোনো দায় আমরা রাখি না।

এই যদি আমার বাবার এক বন্ধুর কথা মনে করি। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তিনি সক্রিয় রাজনীতি করতেন। জগত ধর্ম আর আমেরিকা শূন্য হয়ে পড়লেই যে মানুষ আত্যন্তিক মঙ্গল, সে নিয়ে ওঁর কোনো সংশয় ছিল না। আমাদের বাড়ি সন্ধ্যেবেলা আসতেন, আমার টেবিলে রাখা পরমহংসের ছবি দেখে, কতরকম স্নায়বিক রোগের কথা আলোচনা করতেন, যা যা পরমহংসদেবের নাকি ছিল। এবং যার জন্য ওইসব কিম্ভুত অভিজ্ঞতা পরমহংসদেবের হত নাকি। আর সেদিনের কলকাতার “ফ্রাস্ট্রেটেড”, “এস্কেপিস্ট” কিছু মানুষ কীভাবে ওঁকে ঘিরে একটা লোক ঠকানো প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলল এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতেন। আমি শুনতাম। বাবা শুনতেন। মা শুনতেন। এবং পরমহংসদেবও শুনতেন গোবেচারা মুখ করে ছবি থেকে। আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম উনি কখন তিন কাপ চা, চারটে চার্মিনার শেষ করে উঠবেন, আমরা ডিনারে বসব। যা হোক, একবার তো তিনি পুরোদস্তুর ক্ষেপে উঠলেন আসন্ন কম্পিউটারের বিরুদ্ধে। মানুষ কর্মহীন হবে, বেরোজগার হবে, আমার এবং আশু আমার বয়সী সবাই ভবিষ্যতে কর্মহীন হতে চলেছি, এ নিয়ে আমাদের বিশদে বোঝাতেন। উত্তেজিত হতেন। আরো চায়ের কাপ বাড়ত, সিগারেটের পরিমাণ বাড়ত। উনি বলে বলে হাঁপিয়ে যেতেন। আমরা শুনে শুনে।

এখন অবিশ্যি দিনকাল বদলেছে। তাঁর ছেলে আমেরিকার একটা বড় MNCতে কাজ করে। সে মার্কিন মুলুকে উড়ে উনি যান। ওঁর স্ত্রী যান। ওঁর মেয়ে জামাই যান না। জামাই স্কুল শিক্ষক। তিনি শ্বশুরের প্রাচীন সংস্করণের অনুগামী। তাই শ্বশুরের বর্তমান সংস্করণ জামাইয়ের থেকে দূরত্ব রাখেন শুনলাম।

যা হোক, এ সব পরচর্চায় কাজ নেই। চরিত্রের উন্নতি কীসে হয় সেই নিয়ে ভাবি। প্রথম কথা মানুষের চরিত্রটা লম্বা টাইপের জিনিস, না গোল টাইপের বস্তু সেটাই এখনও টের পেলাম না। তবে ইদানীং মনে হয় গোল। যেখান থেকেই শুরু করো না কেন, ঘুরেফিরে ও আবার শুরুর জায়গাতেই চলে আসে। লম্বা জিনিস হলে যেমন উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে ফারাক রাখা যায়, গোল জিনিস হলে রাখা তো কঠিন। কিন্তু আরেকটা কথা, সব গোল জিনিসের তো একটা কেন্দ্রবিন্দুও থাকে। মানুষের চরিত্রটা যদি গোল, তবে কেন্দ্রে কী? মানুষ? না আদিম মানুষ? নাকি মহামানব?

এই নিয়ে তো বাউলে আর ফ্রয়েডে কী কোন্দল দাদা। বাউল বলে কেন্দ্রে আছে সোনার মানুষ, আর ফ্রয়েড বলে, কাঁচকলা, কেন্দ্রে আছে আদিমমানব, সে ভালোও না, মন্দ না। এই শুনে ব্রহ্মজ্ঞানী হাই তুলে বলে, আমি আগেই জানতুম, সে ব্রহ্মাব্যাটা ভালোও না, মন্দও না। সেই ব্রহ্মজ্ঞানীকে কার্ল ইয়ুং চুপ করায় এটা সেটা খেলনা দিয়ে। কিন্তু কেন্দ্রে যে কী দাদা, সে এক রহস্য। সে রহস্য জানা না অবধি আমি আপাতত আর চরিত্র উন্নতির চেষ্টাটা করছিনা বুঝলেন। যা মডেল আছে সে-ই নিয়ে কাজ চালিয়ে নিই। জিনিসটা যদি গোলই হয়, তবে আর বেকার বেগার খেটে কী হবে!