দলিত সাহিত্য নিয়ে যখন বেজায় রঙ্গতামাশা হচ্ছিল, আমি চুপ করেছিলাম। কারণ কয়েকটা নাম আর তাদের লেখা - জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে। আরো নিবিড়ভাবে পরিচয় করালো একটা বই - দলিত। প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য অকাদেমী থেকে। সেখানে দুটো পটভূমি আছে, আম্বেদকর আর অর্জুন ডাঙলের। প্রথমটা দলিত সমাজ নিয়ে, দ্বিতীয়টা দলিত সাহিত্য নিয়ে। তারপর আছে সারা ভারতের নানা ভাষায় লেখা দলিত সাহিত্যের কিছু কিছু লেখা, বাংলায়।
সত্যি বলতে সাহিত্য যদি সমাজের দর্পণ হয়ে থাকে, তবে এ দর্পণের কাঁচ ছাড়া কিছু নেই। অন্যান্য দর্পণের চারদিকে যেমন নকশা থাকে, কাঁচের নানা তারতম্য থাকে এখানে কিচ্ছু পাবেন না। শুধু একটা কাঁচ। বড্ড স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব ফোটাতে পারে এমন একটা কাঁচ। আমার কাঁচটা ধরে থাকতে থাকতে হাত কেটেছে। রক্তারক্তি হয়েছি। বারবার বলেছি নিজেকে, এদের কথা কেউ তো বলেনি আমায় এমন স্পষ্ট করে! কুলীন সাহিত্যের থেকে মাথাটা নামিয়ে না ঘুরিয়ে বলব জানি না, কেউ বলেনি তো! আরো আছে, জ্যোতিরাও ফুলের লেখা - গুলামগিরি। কতটা বুক ঝাঁঝরা হলে এতটা স্পষ্ট আলো দেখা যায় তা বলতে পারি না। কিন্তু যখন তিনি খ্রীষ্টান মিশনারীদের দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করেন তখন বুঝতে পারি কেন বলছেন সে কথা।
আমার মামাবাড়ি উড়িষ্যায়, কালাহাণ্ডীতে। দাদু সরকারি হাস্পাতালের সার্জেন ছিলেন। বাঙালী, কিন্তু অবশ্যই প্রবাসী। মায়ের মুখে শুনেছি ওখানে যারা দলিত তারা ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত নিজের সন্তানের জন্য রাখতে পারতেন না। নাম হত গুখাই, মুতখাই। আমাদের বাড়িতে একজন দলিত উড়িয়া জল দিতে আসতেন তার নাম ছিল দুর্যোধন। আমি তখন ছোটো। ঠাকুমার মুখে মহাভারত শুনে দেখলাম দুর্যোধন মানুষটা মোটেও ভালো নয়। দুর্যোধনকে এক দুপুরে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাবা-মা তোমায় এমন খারাপ লোকের নাম দিল কেন? অর্জুন, ভীম রাখতে অসুবিধা কি ছিল? সে হেসে বলেছিল, আমরা যে নীচু জাত। সেদিন বুঝিনি, পরে বুঝেছিলাম। পরে যখনই বর্ণাশ্রম নিয়ে নানা মধুর আলোচনা শুনেছি, মনে সংশয় জেগেছে - সত্যিই কি তাই? সে আলোচনায় বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ (অবশ্য প্রথমদিকে), আমাদের নানা সাধু, অবতারেরাও বাদ যান না। কিন্তু আমার বারবার মনে হত এ যেন সত্যভ্রষ্টতা কোথাও। ঈশ্বর যদি এক হবেন, তবে মানুষের মধ্যে ভেদ হবে, কিন্তু অস্পৃশ্যতা? কেউ কেউ বলেন, অস্পৃশ্যতা খারাপ কিন্তু বর্ণাশ্রম ভালো। আমার মনে ধরে না। তাই কি হয়? রোগের জীবাণুটাকে রেখে দিয়ে রোগের লক্ষণ কি তুলে ফেলা যায়? যায় না। যে ভেদাভেদের কারণ শুধুমাত্র বংশগত সেখানে সত্যের মূল্য কতটুকু? খ্রীস্ট, বুদ্ধ --- এনাদের মত মানুষেরা তবে সে ভেদ অস্বীকার করলেন কেন?
সে তর্ক থাক। কিন্তু মায়ের মুখে শুনেছিলাম যে গ্রামে যে সব মানুষের ছায়া মাড়ালে আবার স্নান করত উচ্চবর্ণেরা, যাদের বাড়ির উঠানে ঢোকার সাহস পর্যন্ত ছিল না, তারাই মানু্ষের মর্যাদা পেত খ্রীষ্টান মিশনারীদের শিক্ষায়, ধর্মান্তরণে। তারাই আবার খ্রীষ্টান হয়ে গিয়ে উচ্চবর্ণের সাথে মেশার অধিকার পেত। কি ভণ্ডামী। ওই গ্রামে গিয়েও মিশনারীরা হাস্পাতাল খুলেছিল যেখানে সমস্ত মানুষের চিকিৎসা হত মানুষের মর্যাদাতেই। মনে রাখা উচিৎ, বাঙালিদের তীর্থক্ষেত্র তুল্য ভেলোর হাস্পাতালও ইডা স্কাডার নামক এক প্রকারান্তরে মিশনারীদের বানানো। ফুলেকে পড়লে বোঝা যায় কিভাবে মনুষ্যত্বের মর্যাদা দলিতেরা পেয়েছিল মিশনারীদের থেকে। আরো বোঝা যায় জিম করবেটের 'আমার ভারত' পড়লে। শোষণ কি মাত্রায় হত!
উচ্চবর্ণের প্রতি আনুগত্য আমাদের চলনে বলনে চিন্তায় থেকেই যাবে। আমাদের অজান্তেই আছে। খুব ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পৈতেধারীর প্রচ্ছন্ন উন্নাসিকতার রঙ। যেদিন পৈতে ফেলে দিয়েছিলাম সেদিন পরিবারের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের ভর্ৎসনা ও রামকৃষ্ণ মিশনের কিছু সন্ন্যাসীর সাবধানমূলক উপদেশে বুঝেছিলাম জ্যোতিরাও ফুলের চলা এখনও শেষ হওয়ার নয়।
এ আলোচনা শেষ হওয়ার নয়। তবে আজ যখন হাতরাসের ঘটনাটার আগুনের পরেই আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল, আমি সাবিত্রী ফুলের দিকেই হাত বাড়ালাম। গান্ধী নয়, রবীন্দ্রনাথ নয়, বিবেকানন্দ নয়, সুভাষ নয়। যদি সে লড়াইয়ে আজ কাউকে দরকার পাশে সে হল জ্যোতিরাও আর সাবিত্রীবাই ফুলেকে। অনেক অনেক অন্ধকার জমে, নানা মধুর আবরণের আড়ালে। না জাগলে সতিই বিপদ। থমাস পাইন জাগিয়েছিল ফুলেকে। যে থমাস পাইন প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে ত্যাগ করে একেশ্বরবাদকে চিনেছিলেন, অনেকটা রামমোহনের মত। একের মধ্যে ভেদ নেই। কিন্তু একীকরণ সব সময়েই কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের হাতের ছড়ি হয়ে থাকে। ধর্ম যার সহায় হয়। সমাজের কিছু মানুষের যাদুকাঠি হয়। ঈশ্বর অন্তরের স্বর্গরাজ্য থেকে বাইরের গোষ্ঠী পিতা হয়; এবং সর্বনাশ হয়।