Skip to main content

 

 

খগেনের বউ খগেনকে মারে। খগেনের তাতে কোনো আপত্তি নেই। খগেনের আপত্তি তার বউ তাকে মারার পর কাঁদে বলে। খগেন অনেকবার বলেছে, মারার পর কেঁদো না, কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। মা'কে বাবা মদ খেয়ে এসে মারত। আমার ভালো লাগত না। আমি মদ খাই। মাগীবাজ আমি। কিন্তু তোমার গায়ে হাত তো তুলি না। কাঁদো কেন? খগেনের বাবা পাতকুয়ো তলায় পা পিছলে পড়ে মরেছিল। পাড়ার লোকে বলে খগেন ঠেলা দিয়েছিল। খগেনের মা বলে, না না না। যতবার বলে ততবার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, চোখ ফেটে জল আসে। এখন 'না না না' বলে না। পক্ষাঘাতে শুয়ে আছে। বারান্দার। সিঁড়ির নীচে। আর ঘর কোথায়? খগেন আজ মদ খায়নি। ক'দিন আগে রক্তবমি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আর বেশিদিন নেই। কিন্তু খগেনের তা বিশ্বাস হয় না। তার হাত দেখিয়েছে বারুইপুরের বড় জ্যোতিষীর কাছে। সে বলেছে, খগেন সাতাশি বছর বয়সে মরবে। এখন তো সবে আটচল্লিশ। খগেন ঘরে এসে দেখে নূপুর শুয়ে আছে আলো বন্ধ করে ঘরে। খগেন কিছু জিজ্ঞাসা না করে চায়ের জল চাপালো। দু'কাপ চা করে নিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকল। বলল, চা নাও। নূপুর সাড়া দিল না। খগেন মাথার উপর হাত রাখল। নূপুর বলল, চেয়ারটা টেনে বসো। খগেন বসল। নূপুর বলল, আমি চলে যাচ্ছি। খগেন শুনল। কথাটা সে জানে। অনেকদিন ধরে শুনছে। সে লোকটা নাকি স্টেশানে আসে। নূপুর চা খায়। কেক খায়। গল্প করে। নূপুর খুশি হলে কেক খায়। খগেন চায়ে চুমুক দিল। নূপুর বলল, তুমি জানো তো। খগেন মাথা নাড়ল। অন্ধকার থাকা সত্ত্বেও নূপুর বুঝতে পারল। নূপুর বলল, আমাকে নিয়ে তুমি সুখী নও। আমিও না। মা-কে দেখো। মদটা ছাড়ো। নূপুর উঠে গেছে। এখন খেয়াল করল নূপুর বাইরে যাওয়ার শাড়ি পরে আছে। খাটের পায়ের কাছে দুটো ব্যাগ। নূপুর ব্যাগদুটো নিয়ে বেরিয়ে গেল। খগেনের চা শেষ। নূপুরের চায়ের কাপটা নিয়ে বসে থাকল। গরমটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণে হুঁশ এলো মনে নেই। নূপুরের ফোনে দু'বার রিং করল। সুইচ অফ্‌ বলছে। রাত অনেক। জ্যোতিষী মিথ্যা বলেছে। সাতাশি বছর অবধি কেউ বাঁচে? মা ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে। হাতে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ধরা। মায়ের হাতে বাবা কোনোদিন টাকা দেয়নি। সেও দেয়নি। নূপুর দিত। মাসের এক তারিখ। মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। গাল বেয়ে জল গড়াত। টাকাটা একবেলা দিত না। মুঠো শক্ত করে ধরে থাকত। পরে একসময় পড়ে থাকত মায়ের ডানদিকে। মুঠো আলগা হয়ে। খগেন টাকাটায় হাত দিল। টাকাটা পড়ে গেল নাইটি বেয়ে খাটে। যেন একটা বাচ্চা স্লিপে চড়ে নামল। খগেন বলল, মা। মা উত্তর দেয় না। বহুদিন। এখনও ছাদের দিকে তাকিয়ে। নূপুরের যাওয়া দেখছে যেন। মায়ের মাথার কাছে চিরকুট। ওষুধের নিয়ম লিখে দেওয়া। খগেন একটা পাঁচশো টাকা নিয়ে রাস্তায় এল। মদ খাবে আজ। মাথার পিণ্ডি চটকে। ঠেকের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ঢুকল না। তার চাইতে মরে যাবে। নূপুর এসে মায়ের মাথার কাছে বসবে। মা মরে যাবে। নূপুর শান্তি পাবে। সে না মরলে মা মরবে না। সে আর মা না মরলে নূপুর শান্তি পাবে না। খগেন রেলব্রীজের দিকে হাঁটল। মনে আনন্দ হচ্ছে। হয় তো এই ট্রেনে কুন্তিঘাট স্টেশান থেকে উঠবে নূপুর। তার উপর দিয়ে যাবে। যাক। কেউ একজন নাম ধরে ডাকছে। খগেনদা… তাড়াতাড়ি এসো মাসিমা নেই মনে হচ্ছে…. খগেনদা…। খগেন মায়ের কাজ শেষ করে বারান্দায় বসে আছে মাসখানেক পর হবে। পিওন এল। তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলল, এসেছিল আগেই। দিতে আসতে পারিনি। পেট খারাপ ছিল। নূপুর লিখেছে, মায়ের কাজের জন্য। খগেন নিল না। ফিরিয়ে দিল। পিওন চলে গেল। খগেন মদের বোতল আর চানাচুর নিয়ে ঘরে গিয়ে বসল। আত্মহত্যা করতে ভয় লাগে। নেশা ভাঙলেই ভয় লাগে। আগেরদিনের কথা পরেরদিন মনে পড়লে ভয় লাগে। ঘুম থেকে উঠলে ভয় লাগে। সকালের আলোকে ভয় লাগে। রাত যত বাড়ে ভালো লাগে। রাতের মধ্যে নূপুর আছে। মা আছে। বাবা আছে। সে আছে। খগেন দিনের মধ্যে রাত তৈরি করে। নূপুরের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় রাতের পর রাত যায়। নূপুর এল একদিন। কিন্তু ততক্ষণে সে নাভিকুণ্ড হয়ে গঙ্গায় ভেসে গেছে অনেকদূর। ধোঁয়াও মিলিয়ে গেছে ধোঁয়া ধোঁয়া আকাশে।