Skip to main content

 

“মা পেট ভরেছে?”

বুড়ি আজীবন বাসন মেজে কাটিয়েছে। কতবাড়ির ঠিকে ঝি ছিল মনে নেই। কত অনুষ্ঠান বাড়ি ঝিয়ের কাজে গেছে মনে নেই। কিন্তু ওতেই নিজের সংসার চালিয়েছে। সেই ছেলে চাকরি পেয়েছে। তারাপীঠে নিয়ে এসেছে মাকে। সঙ্গে ছেলের বউ।

বউ গিয়ে মাকে চেয়ার থেকে ধরে তুলল। কোমরটা বসে গেছে একদম। একবারে নড়তে চড়তে চায় না। হোটেলের বাইরে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখে এর ওর বাসন মাজা। ছাই দিয়ে, সাবান দিয়ে, ওষুধের খোলা দিয়ে, ছোবড়া দিয়ে..কখন কীসে ভালো মাজা হয় তার সব জানা। কিন্তু এখন? পেটের মধ্যে মাছ ভাত ভর্তি, টলমল করছে। ভর্তি পেট। ব্যথা করছে বুকের নীচটা। ছেলে আর বউ দোকানে দাঁড়িয়ে। বুড়ি একটা হোটেলের বাইরে উবু হয়ে বসা একজন তারই বয়সি বুড়িকে দেখছে। দেখতে দেখতে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, মশা তো, একটা ডিমের পিজবোর্ড জ্বালিয়ে নাও না কেন?

সে মুখের দিকে না তাকিয়েই বলল, কে দেবে?

বুড়ি কষ্ট হলেও এগোলো। দু একটা দোকানের পর একটা মুদির দোকানের সামনে দাঁড়ালো। লোকটাকে বলল, দুটো ডিমের পিজবোর্ড দাও তো।

এমনি হবে না। দশটা টাকা দাও।

বুড়ি ব্লাউজের মধ্যে থেকে টাকার ব্যাগটা বার করল। দশটা টাকা দিয়ে ডিমের পিজবোর্ড হাতে নিয়ে বুড়িটাকে বলল, দাঁড়াও জ্বালিয়ে দিই। সিঁড়ি বেয়ে হোটেলের রিসেপশানে এলো। মায়ের বড় ছবি টাঙানো দেওয়ালে। দু হাত জড়ো করে প্রণাম করল। বলল, একটা দেশলাই দাও তো?

রিসেপশানের ছেলেটা বলল, কেন ঠাকুমা? বিড়ি খাবে?

বুড়ি বলল, বাইরে তোমার ঠাকুমার বয়সি মানুষটা বসে বসে মশার কামড় খেতে খেতে বাসন মাজছে। ওর জন্যে ক'টা ডিমের পিজবোর্ড জোগাড় করেছি। দাও তো ক'টা জ্বালিয়ে দিই।

ছেলেটা রিসেপশান থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে লাইটার। বাসনমাজা মানুষটার কাছে গিয়ে বলল, দাও…জ্বালিয়ে দিই।

ছেলেটা চলে গেল। বাসন মাজা বুড়ি মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কেউ ভাবে না আজকাল।

বুড়ি বলল, কোনোদিনই কেউ ভাবে না। আজকাল বলে না। বলতে বলতে মুখটা টকে গেল। মাছের ঢেকুর উঠল।

ছেলে ডাকল, মা, হয়ে গেছে। এদিকে এসো।

পেট ভর্তি মাছের ঝোল, ভাত, মিষ্টি দই। কলকল করছে। অম্বল হচ্ছে। হোটেলে যাচ্ছে তারা। কিন্তু ইচ্ছা করছে না। হিংসা হচ্ছে। ওই বসে বসে বাসনমাজা বুড়িটার জন্য হিংসা হচ্ছে। ইচ্ছা হলেই সব ছেড়ে যেতে পারে। আবার পারেও না। নিজের হাতে সব। কিন্তু তার যেন কিছুই নিজের হাতে নেই। ভালোবাসা আছে, সুরক্ষা আছে, নিশ্চিত জীবন। কিন্তু তাদের গ্রামের পুকুরটা….সব সময় নিশ্চল….কালবৈশাখীর ঝড়ের সময় তার কী রূপ! তার মনে হত ভয়ে পুকুরটা ওরকম করছে বুঝি….এখন বোঝে ওইটাই ওর আনন্দ…..তারও ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে….চাইছে না যেতে….কিন্তু যাবে কোথায়?

তোরা হোটেলে যা….আমি একটু মন্দির হয়ে আসি?

একদম না….হারিয়ে গেলে…পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে…এই খেলে.. একটু শোবে না….চলো চলো….

বুড়ি যেতে যেতে দেখল, আগেরজন বাসন মাজছে….তার পাশে রাখা ডিমের পিজবোর্ড জ্বালা ধোঁয়া…..হিংসা…. হিংসা…..টক ঢেকুর উঠল। ভরা পেটের সুখের ঢেকুর….অন্তত সংসারে তাই বলে….সংসার হৃদয় থেকে এত দূরে কেন মা?.....তুমি হৃদয়ে, না সংসারে?

হোটেলে এসে ঢুকল। ছেলে বলল, দাঁড়াও, তোমার জন্য কোলড্রিংক্স আনি….ও বলল তোমার ঢেকুর উঠছিল……

বুড়ির গলার কাছে হিংসা ফেটে সুখ জন্মালো। প্রজাপতির মত উড়ে বসল দুটো কানের দুলে। মাকে বলল, মা…আমি কী চাই…কী চাই…..