ঠাকুমা, তোমার মনে আছে, তুমি সেই গ্রামের বন্যার গল্প বলতে। তোমার শ্বশুর মশায় নাকি হাঁড়িকড়াই, ছাতা নিয়ে ভাসতে ভাসতে বলেছিলেন, বউমা..... ধবলীর গলার দড়িখান খুইল্যা এইসোনে....
ধবলী তোমাদের গরু ছিল। আর ফিরে আসেনি। তুমি সাঁতার কাটতে কাটতে খাটালে ঢুকে ধবলীর গলার দড়ি খুলে দিয়েছিলে। কেঁদেছিলে। ধবলীও কেঁদেছিল। তুমি বলোনি, আমি ভেবে নিয়েছিলাম।
আমি কতদিন রাতে স্বপ্ন দেখেছি জানো, ধবলী ভাসতে ভাসতে এ নদী, সে নদী পেরিয়ে কোথায় গিয়ে পড়েছে। কাউকে চিনতে পারছে না। কাঁদছে। ধবলী আমায় যেন চেনে। আমি গিয়ে ধবলীকে নিয়ে আসছি।
কিন্তু এনে কোথায় রাখব? আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে ঘাস কই? সব তো সিমেন্ট। এমনকি মাঠেও কয়েক ছটাক ঘাস ছেড়ে দিলে শুধু ধুলো আর মাটি। ধবলী খাবে কি?
জানি গরু বললে লোকে রেগে যায়। কিন্তু আমার নিজেকে ধবলীর মত লাগত। যেন হারিয়ে গেছি। আমাকে কেউ চিনতে পারছে না। আমি ধবলীকে বুঝতে পারতাম।
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে কি বন্যা গো ঠাকুমা। সব ভেসে যাচ্ছে। ঘর, বাড়ি, রাস্তাঘাট, গাড়ি, মানুষ, পশু সব। মনে আছে খুব জোর বাজ পড়লে, বৃষ্টি হলে তুমি পিঁড়ি পেতে দিতে কুয়োপাড়ে। শাঁখ বাজাতে জোরে জোরে। আমার মনে হত তোমার সেই শাঁখের আওয়াজেই বাজ বৃষ্টি কমে যেত।
এখন নাকি সব ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য হচ্ছে বলছে জানো। মানে আমাদের পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। সে শাঁখ বোঝে না, পিঁড়ি বোঝে না। কি সব জটিল জটিল অঙ্কের হিসাব করে, আলোচনা করে, আর খালি খালি বই ছাপে।
জানো ঠাকুমা, আমি একটা কথা স্পষ্ট বুঝেছি, এরা সব করে, কিন্তু কেউ ভয় পায় না তোমার মত, তাই এদের কাজে কিচ্ছু হয় না। এরা শুধু কথা বলে, আর বই ছাপে, আর নিয়ম বানায়। তোমার মত আন্তরিকতায় পিঁড়ি না পাতুক, শাঁখ না বাজাক, কিন্তু ভয়টা তো পাক! কিচ্ছু পাচ্ছে না গো। বাচ্চারা রিলে বন্যার ভিডিও দেখেই, ইস, বলেই পরেরটায় গানের, কি নাচের, কি হাসির ভিডিওতে চলে যাচ্ছে। আর বড়রা হাসি হাসি মুখে হ্যান করেঙ্গে, ত্যান করেঙ্গে বলে আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছে। চাট্টি বোক্তিতা করেই পার্টি করতে শুরু করে দিচ্ছে।
আসলে এদের ধবলী হারায়নি তো ঠাকুমা। তাই এদের প্রাণে ভয় নেই গো। আমাদের এইটুকু বাড়ি, আমরা ক'টা গাছ লাগাবো গো? টবে ক'টা গাছ হয়? বড়জোর প্লাস্টিক নিলাম না। তুমি তো সব ঠোঙায় আনতে। অত প্লাস্টিক কোথায় থাকত বলো দোকানে? আমরা কি আর করি তবে ঠাকুমা? ধবলী হারানোর ব্যথা যার প্রাণে নেই, সে যত আলোচনাই করুক, কাজের কাজ তো কিছুই হবে না।
আমরা বরং ভয় দেখাই সবাইকে। বাচ্চাদেরকে বিশেষ করে। ভয় দেখানো মানে সাবধান করা ভয় দেখানো। যেমন বলি, খেতে খেতে হাসবি না… গলায় আটকে যাবে…. তেমন। তুমি ধবলীর গল্প বলো। আমি ধবলীকে নিয়ে দেখা দু:স্বপ্নের গল্প বলি। মিটিং করে, বই ছাপিয়ে, কঠিন কথা বলে কি লাভ বলো? আমাদের কি তা সাজে? না আমাদের অত বুদ্ধি আছে? আমাদের শুধু শূন্য খাটাল, আর ধবলী হারানোর স্মৃতি আছে। যারা আজ সবটুকু হারিয়ে মারা যাচ্ছে, নি:স্ব হচ্ছে, তারাও জানে না এত হিসাব। কাদের গা জোয়ারিতে এসব হচ্ছে তারা কিচ্ছু জানে না। কিন্তু তা বলে তো হাল ছাড়লে চলবে না ঠাকুমা। আমি ন্যাশেনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখেছি, একটা হরিণকে বাঘ পেছনের দিকে কতটা খেয়ে ফেলেছে, সব নাড়িভুড়ি জঙ্গলের ঘাসে রক্তারক্তি হয়ে লুটিয়ে, তবু সে দাঁড়িয়ে আছে, নিজেকে বাঁচাতে চাইছে। সেই তো জীবন ঠাকুমা… আমাদের অনেক ধবলীকে বাঁচাতে হবে…. আমরাও যে ধবলী বুঝতে হবে…. ভেসে গেলে গরুই বা কি, আর মানুষই বা কি….