মন যদি নদী হয়, তবে সে নদীর জোয়ার ভাটার সাক্ষী কে গোঁসাই?
গোঁসাই গোলাপ গাছের গোড়ায় আরেকটু মাটি চেপে বলল, চেতনা।
গোঁসাই উঠে দাঁড়ালো। কোমরটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমার সঙ্গে এদিকে এসো দেখি একবার।
বেশ কয়েকটা টব, মাটি আছে, গাছ নেই। গোঁসাই হাতে ধরিয়ে বলল, বাইরে রাখো দেখি, রোদে না, ওই আমগাছের ছায়ার নীচে।
টব রাখা হল। আম গাছের ছায়ার নীচে আমি আর গোঁসাই বসে। সামনে গঙ্গা। বেশ রোদ।
গোঁসাই বলল, চেতনা অব্যক্ত... ওকে চেনা যায় না…. গানে আভাস পাওয়া যায়…. ভাষার অভাব সুরে মেটানোকেই বলে গান…. ভাষা ছুঁতে পারে না.. সুর পারে.. উপনিষদে বলছে মন আর বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে…. কিন্তু সুর ফিরে আসে বলেছে?... সুর ফিরে আসে না... ফিরিয়ে নিয়ে যায়... তাই ভালো একটা গানের রেশে কান্না লেগে থাকে….
কিন্তু সবাই তো সুরের রসিক হয় না…..
সুর বোঝে না এমন মানুষ নেই… এই যে তুমি ডাকো…. কথা বলো... মানুষ মনোভাব বোঝে সুরে না শব্দে? ভাব মানেই সুর…. আর মন মানেই শব্দ... মনোভাব মানে সুর আর শব্দের মিলন…. যা তুমি আর আমি…. আমরা সবাই….
মন শব্দ কেন?
মন তো শব্দের নিগড়ে বাঁধা। অন্যকেও সেই শিকলে বাঁধতে চায়... শব্দের শিকল….
সে শিকল খোলায় কে?...
কথা শেষ হল না... হঠাৎ একজন মহিলা আলুথালু বেশে কাঁদতে কাঁদতে গোঁসাইয়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল….
গোঁসাই বলল, ওঠ... আবার মেরেছে?
মহিলা মাথা তুলে তাকালো….
চল দেখি…
গোঁসাইয়ের পিছনে পিছনে আমিও হাঁটতে শুরু করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম না যদিও, সে না যাওয়ার হলে আমায় মাঝপথেই না হয় থামিয়ে দেবে গোঁসাই। গোঁসাই বড় রাস্তাটা ছেড়ে মাঠে নেমে গেল। মাঠের ওদিকে বস্তি এলাকা। বুঝলাম ঘটনাটা ওদিকের।
বস্তিতে ঢুকতেই কয়েকজন নারী পুরুষ আমাদের সঙ্গ নিল। সে তো নেবেই। মজা দেখার লোকের কোনো সমাজেই অভাব নেই। কেউ দেখে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে, কেউ প্রকাশ্যে। গোঁসাই ভ্রুক্ষেপহীন। এ গলি সে গলি কয়েকটা পাক খেয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলা এতক্ষণ কাঁদছিল না। এইবার বাড়ির সামনে এসে মাটিতে পড়ে আবার কাঁদতে শুরু করল।
টিনের ছাওনি দেওয়া, দর্মার বাড়ি। গোঁসাই মহিলাকে ধমকে বলল, চুপ কর… বলতে বলতেই ঘরের ভিতর ঢুকে গেল…
ঘরের ভিতরটা ঢুকেই প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভীষণ অন্ধকার। বাইরে চড়া রোদ। একটু পরে দৃষ্টি স্বাভাবিক হতে দেখলাম একজন পঙ্গু মানুষ দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। খুব সম্ভবত পোলিও মনে হল পা দুটো দেখে। এই মানুষ মারে কি করে?
গোঁসাই সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটা অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে। চোয়াল দুটো শক্ত।
গোঁসাই বলল, আবার মেরেছিস?
লোকটা চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে। খানিক বাদে বলল, ও নিজেই তো এসেছিল মার খেতে… ও জানে না আমার মাথার ঠিক থাকে না সব সময়…. আমার থেকে দূরে থাকলেই পারে... তোমাদের আশ্রমেও চলে যেতে পারে... আমি তো মানা করিনি….
গোঁসাই বলল, তুমি পাষণ্ড একটা... দিন দিন আরো হচ্ছ তাই….
লোকটা চুপ করে থাকল।
গোঁসাই বলল, ও বলে এতদিন….
লোকটা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলল... কে বলেছে ওকে থাকতে... আমার মত জন্ম পঙ্গু তো সারার না কোনোদিন... ও জানত না?... কে বলেছিল আমায় দয়া দেখাতে….?
কেউ তোমায় দয়া দেখায় না….
মহিলা কখন ঘরে এসেছে খেয়াল করিনি…. সেই কান্না চাপা গলায় বলল…
গোঁসাই বলল, তুই চুপ কর রমা….
গোঁসাই বলল, আমি কতবার বলেছি আশ্রমে চ... কতরকম কাজ সেখানে…. তুই থাকলে আমারও কত সুবিধা….
ঢং কোরো না গোঁসাই…. পঙ্গুকে দিয়ে কোনো কাজ নেই... সে তোমারও নেই.. তোমার ভগবানেরও নেই…..
গোঁসাই বলল, ভগবান তো জন্ম পঙ্গু রে…. মানুষ খাওয়ালে খায়... মানুষ শোয়ালে শোয়... মানুষ রথে চড়ালে চড়ে.. মানুষ হাঁটালে হাঁটে… মানুষ বসালে বসে…
লোকটা বলল, ও তোমার ভাবের কথা গোঁসাই... ওতে পেট চলে না….
দেখ পরিতোষ…. মানুষের শুধু পেট চললেই চলে না…. বুকের ভিতরটারও চলা চাই... আশ্রমে কাজ করলে দুই হত... কি সুন্দর গানের গলা তোর….
থাক গোঁসাই…. সে আশ্রমে যাওয়ার মুখ আমার নেই তুমিও জানো…. চুরি যে করেছিলাম সে তো মিথ্যা নয়?..., আর সেই অপরাধেই আমার জলজ্যান্ত মেয়েটা দুদিনের জ্বরে…..
আমি চমকে গেলাম। আড়চোখে মহিলার দিকে তাকালাম। আসবাবের মত বসে আছে। দেওয়ালে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি দেখলাম। লাল ফ্রক পরা, মাথায় লাল ফিতে। বুকটা এক মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। গোঁসাই হাঁটু মুড়ে বসে। লোকটার মাথাটা গোঁসাইয়ের বুকে। কান্নার বেগে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
গোঁসাই বলল, আমার গোবিন্দকে তুই এত বড় বিষয়ী, নিষ্ঠুর ভাবলি রে? দুটো বাসন সবাইকে না বলে নিয়ে এসেছিলি বলে সে তোর অমন ভোরের আলোর মত ফুটফুটে শিশুটাকে নিয়ে নেবে?... গোঁসাইয়ের গলা বুজে এলো….
তাই তো নিল গোঁসাই… তাই তো নিল... গোঁসাইকে জাপটে ধরে কেঁদেই চলেছে পরিতোষ….
গোঁসাই বলল, আমাদের হিসেবী বুদ্ধিতে সংসারের সব হিসাব মেলে না পরিতোষ…. যা গেছে তা গেছেই…. তাকে যেতে দিলেই আমাদের শান্তি... বুঝিস... কিন্তু মানিস না….
তা হয় না গোঁসাই… আমি সারাটা জীবন রমাকে কিছু সুখ দিতে পারলাম না... যা-ও বা একটা মেয়ে এলো ঘর আলো করে... সেও আমার পাপে ওর কোল থেকে কেড়ে নিল তোমার গোবিন্দ…..
মহিলা উঠে এসে পরিতোষের মাথাটা জড়িয়ে বলল, চুপ করো... চুপ করো.. তুমি গায়ে হাত তুলেছিলে বলে আমি গোঁসাইয়ের কাছে যাইনি... তোমায় এই সময়ে আমি চিনতে পারি না... আমার ভীষণ ভয় করে... মনে হয় তুমিও যদি চলে যাও…..
পরিতোষের চোখদুটো লাল। চুলগুলো উসকোখুসকো। সে মাথা তুলে রমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি আমায় কেউ ক্ষমা করেনি… না তুমি… না গোঁসাই… না ভগবান…. আমায় তোমরা মেরে কেন ফেলছ না…. কেন আমাকেও নিয়ে নিচ্ছে না তোমার গোবিন্দ গোঁসাই….
গোঁসাই শান্ত গলায় বলল, পরিতোষ, নিজেকে ক্ষমা করো আগে। দেখবে সবাই তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করেছে। বুঝতে পারোনি তুমি। তুমি নিজেকে আগে ক্ষমা করো... আর পাগল হোয়ো না…. তোমাদের বস্তিতে এত বাচ্চা... ফুলমণিকে ওদের মধ্যে দেখতে পাও না কেন? ওদের নিয়ে বাঁচো…. পরিতোষ শুধু খেয়ে শ্বাস নিয়ে মানুষ বাঁচে না…
গোঁসাই আর আমি ফিরছি আশ্রমে। গোঁসাই বলল, কি যেন জিজ্ঞাসা করছিলে….
আমি বললাম, কিছু না।
গোঁসাই হেসে বলল, সেই ভালো, চলো আজকেই চারাগুলো টবে লাগিয়ে ফেলি…. দেরি হলে বর্ষা পাবে না গাছগুলো….