Skip to main content

এমনকি জগদীশ যখন ইতিমধ্যে মৃত স্ত্রী'র শরীরটা টুকরো টুকরো করছে, তখনও তার মনে হচ্ছে সে ঠিক করছে। ঝুম্পা যখন জগদীশের করাল মুষ্টির মধ্যে থেকে শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছিল তখনও জগদীশের মনে হচ্ছিল সে ঠিক করছে। 

    যে ঘুষ নেয়, যে ডাকাতি করে, যে মিথ্যাকথা বলে ইত্যাদি যে কোনো খারাপ কাজের উদাহরণ আপনি দিন, দেখবেন সেই সব অপরাধীর অন্তত সেই সময়টা মনে হয়েছে সে ঠিক করেছে। 

    আমার এত বছরের ওকালতি জীবনে আমি প্রায় এমন কোনো অপরাধীর মুখোমুখি হইনি যার মনে হয়নি, অন্তত সেই সময়টায় মনে হয়নি সে কিছু ভুল করছে। সে যেন একদম ন্যায্য কাজই করছে। এটাই হয়। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা আমি আজ অবধি খুঁজে পাইনি। কিন্তু আজ সুড়ঙ্গের মুখটা দেখতে পেয়েছি। সেই গল্পটাই বলব। 

    আমি এখন বিলাসপুর স্টেশানে বসে। আমার বাবার এক ভাইয়ের কিছু জমিজায়গা এখানে ছিল। সেই ভাই অবিবাহিত, কলেজে পড়াতেন। রিট্যায়ার করার দেড় বছরের মধ্যে মাথার রোগ দেখা যায়। এটায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমার বাবারও একই রোগ ছিল। বাবা মারা গেছেন তিন বছর হল। কাকা এখন আমাদের ওখানে থাকেন, মানে যাদবপুরে। কাকার জাগতিক অস্তিত্বকে আমি আর বাসবী যোগসাজশ করে জগত থেকে মুছে ফেললাম। দেখুন যেহেতু আমার নিজের কথা তাই কেমন শব্দের খেলা খেলছি। আসলে আমি আর বাসবী ষড়যন্ত্র করে কাকার ডেথ সার্টিফিকেট বার করে ফেললাম। শুধু তাই নয়, কাকা যে সম্পত্তি ওনার গুরুদেবের আশ্রমে উইল করে গিয়েছিলেন, এবং বিশ্বাস করে আমাদের কাছে রেখেছিলেন ('বিশ্বাস' শব্দটা উচ্চারণ করতে আমার হাসি পাচ্ছে এখন), আমরা সেটাকে বদলে আমাদের ছেলে, শ্রীমান প্রদ্যুম্ন চ্যাটার্জির নামে করে নিলাম। মানে আমার অকৃতদার কাকা তার সমস্ত জমিজায়গা তার অত্যন্ত আদরের নাতি প্রদ্যুম্নর নামে করে গেলেন। আমি বিলাসপুর এলাম। কয়েকদিন থাকলাম। সমস্ত কিছু ছেলের নামে করিয়ে ফিরছি। এদিকে কয়েক বছর পর একটা কারখানা হবে, জমির দাম আরো বাড়বে তখন এসে বেচে দেব। এইখানে তো আর আমরা কোনো জন্মে কেউ থাকতে আসব না! 

    কিন্তু সবচাইতে মজার কথা কি জানেন, এই যে এতগুলো কাজ পরপর মাথা ঠাণ্ডা রেখে করে গেলাম, আমাদের দু'জনেরই একটুও বিবেকে বাধল না। কথাটা ঠিক হল না। বিবেক বলে কিছু অনুভবই করিনি যখন সেখানে বাধাবাধির কি আছে? বলা ভালো শিক্ষাদীক্ষা রুচিবোধ ইত্যাদি কিছুতেই বাধল না। কি মসৃণ সব। যেন এটাই তো হওয়া উচিৎ। তাই হল। যে কাকা এখন হয়তো ঘুমাচ্ছেন, সেই কাকার মৃত সংশাপত্র আমার ব্যাগে। কি ইনোসেন্ট পেপার একটা। বিশ্ব সংসারে কেউ জানতেও পারল না কতবড় জালিয়াতি ঘটে গেল। আমার অল্প অল্প ভয়মিশ্রিত মন খারাপ হচ্ছিল। কিন্তু সেটা নিছক অভ্যাসের কারণে। কারণ আমি গভীরে ডুবে দেখেছি, আমি প্রসন্ন। আমি খুশী। ডাক্তার যখন ইঞ্জেকশান দেয়, তখন সেই ব্যথাটা স্বীকার করে নিই যেমন, কারণ ওতেই আমার মঙ্গল, এখন এই অল্প একটু ভয়মিশ্রিত অস্বস্তিও সেই একই অনুভূতির প্রকাশ। শিকড় নেই, আবছা অবস্থান আছে মনের উপরিতলে। 

    রাত দেড়টা। ওই প্ল্যাটফর্মে একজন মহিলাকে চুলের মুঠি ধরে দু'জন পুরুষ মারছে। আমি জানি, এই মুহূর্তে ওই পুরুষদের মনে হচ্ছে ওরা ঠিক করছে। যদি ধর্ষণও করে মনে হবে এটাই তাদের করা উচিৎ এখন। আমি চাইলে পুলিশকে জানান দিতে পারি। কিন্তু দেব না। তার একটা কারণ, মানে প্রধান কারণ ওরা ছোটোলোক। আর দ্বিতীয় কারণ দিলেও ওরা এদের জাতটা দেখে কিছু বলবে না, আমায় খিস্তি মেরে চলে যাবে। মহিলাকে প্ল্যাটফর্মে ফেলে লাথি মেরে চলে গেল। মহিলা পেটটার কাছে পা-দুটো কুঁকড়ে শুয়ে আছে। "গরম চায়ে…"। হ্যাঁ দাও, এই নাও টাকা। টাকা ফেরত দাও। যাও এবার। আমি শুয়ে থাকা মহিলাকে দেখি। আমার মধ্যে হালকা যৌন সুড়সুড়ি লাগছে। কি আশ্চর্য মানুষের মন। মনের এক জায়গায় ওর জন্য অনুকম্পা জাগছে। আবার সেই মনেরই আর এক জায়গা অল্প অল্প যৌন কল্পনায় রং চড়াচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি, আমার অল্প সেন্স এসেছে পুরুষাঙ্গে। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী আমার পুরুষাঙ্গ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ইদ (ID), আমার অনুকম্পার ঔচিত্যবোধ জাগাচ্ছে সুপার ইগো। আর আমার ইগো দু'জনের মধ্যে মজা দেখছে। আমি কে? শুদ্ধবুদ্ধমুক্ত আত্মা? বাল! লোভ ছাড়া সংসারকে চালায় কে? কেউ না। ভয়। ভয় আর লোভ। ঈশ্বর মৃত। ঈশ্বরের কবরস্থানের উপর মানবিকতার বুনোঝাড়। বুনোফুল কখনও ফোটে এদিক ওদিক। শুকিয়ে যায়। কেউ খেয়াল করে না। 

    আচ্ছা, বাপন বড় হলে কি সত্যিটা জানবে?

    বাসবী আমার পুরুষাঙ্গ নিয়ে খেলতে খেলতে জিজ্ঞাসা করেছিল। ওই সময় আমরা আমাদের মনের আগল খোলা স্বপ্নগুলো নিয়ে খেলা করি। যেন বিষাক্ত ফলের বাগান। আমি আর বাসবী এসেছি পরিচর্যা করতে। আমরা দস্তুর মত নগ্ন। 

    আমি বলেছিলাম, কি দরকার গায়ে পড়ে জানানো। ও বুঝে যাবে। 

    দেখুন কথার কি প্যাঁচ! আমরা উচ্চারণ করব না আমাদের জালিয়াতির কথা। কিন্তু অবকাশ রেখে দেব বুঝে নেওয়ার যে কোনটা বাস্তব। আমরা ওকে ম্যানারিজম শেখাব। এটিকেট শেখাব। নিজের অ্যাম্বিশানকে সফল করে তোলার জন্য নির্দয়, নিষ্ঠুর হতে শেখাব। বলব এই সময়টা লাইফে ফোকাস করার সময়। বাকি সব কিছুর জন্য গোটা জীবন আছে। অথচ আমরা জানি গোটা জীবন বলে কিচ্ছু হয় না। আমরা লোভ আর ভয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ট্র‍্যাপিজ খেলি আজীবন। 

    ট্রেনের অ্যানাউন্স হল। ট্রেন এলো। কামরার মধ্যে ঘুমন্ত যাত্রী। অবস্থাপন্ন যাত্রীরা। এটা এসি টু টায়ার। নীল আলো জ্বলছে কামরায়। নাক ডাকছে কেউ কেউ। আমার ঢুকেই সাইড লোয়ার। কেউ একজন শুয়ে। আমার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত উল্লাস জন্মালো। আমি লোকটাকে হেনস্থা করব এখন, অপমান করব। ঘুমন্ত মানুষটাকে ঠেলে তুলব। ওর কিছু বলার থাকবে না। কারণ এটা এখন আমার সিট। আমার আর্থিক ক্ষমতায় কেনা। মনের মধ্যে ইতিমধ্যে খিস্তির স্রোত শুরু হয়ে গেছে। জিভে ফুটে ওঠার জন্য লাফাচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে ধাইধপাধপ তবলার বোল ফুটছে। এই বাঁড়া ওঠ…

    দাদা এটা আমার সিট... উঠুন….

    আরে চ্যাটার্জি…

    হুস্... সব বদলে গেল। সব খিস্তিরা গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল। আমার ঠোঁটের আগায় বিস্ময় মিশ্রিত হাসি। আমার ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের জনার্দন হালদার। রাজনীতির লোক। ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। আমি বলছি, আরে উঠবেন না…

    আরে আমার রিজার্ভেশন কনফার্ম হতে হতেও হল না... রায়পুরে একটা মিটিং ছিল... পরের ট্রেনটাতে ফিরলেও হত, এদিকে বাবুটার আবার নাকি সেই অজ্ঞান হওয়াটা শুরু হয়েছে... ফ্লাইটে হল না…

    আরে এত বলার কিছু নেই, দুই ভাই বসে বসে রাতটা কাটিয়ে দেব….

    নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হই মাঝে মাঝে। 'মন রে ওরে মন, তুমি কোন সাধনার ধন', রবীন্দ্রনাথের লেখা। 

    উনি ঘুমাচ্ছেন। আমার জন্য বরাদ্দ সিটের তিরিশ শতাংশ। আমি কোনো রকমে পাছা ঠেকিয়ে বসে। উনি জানেন উনি এটা করতে পারেন। এটাও জানেন আমার কিছু বলার নেই। অন্তত আপাতত নেই। এবং সব চাইতে আশ্চর্য, ওনার এখন মনে হচ্ছে উনি ঠিক কাজ করছেন। কি আশ্চর্য না!

    নীল আলোয় দুলন্ত কামরা। ঘুমন্ত মানুষের সার। একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একজন মহিলা এগিয়ে আসছেন, আমার পা'টা সরাতে বললেন, এক্সকিউজ মি! 

    পা সরালাম। যদি না সরাতাম? সারা কামরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। বলত আমি অভদ্র, অসভ্য, ইতর, ছোটোলোক। যদিও আমরা সবাই জানি আমরা সবাই তাই। 

    ভদ্রমহিলা ফিরলেন। আমাদের মধ্যে সৌজন্যর হাসি বিনিময় হল। আমার ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখনকার ঘুমগুলো প্রথম যৌবনের মত শান্তিপূর্ণ নয়। আজকাল ঘুমে বিলীন হয়ে যাই না। তলিয়ে যাই। স্বপ্নে ভয় পাই। ভয় দেখাই। ঘুমের মধ্যেও আমাদের শয়তানের সঙ্গে সহবাস। শান্তি, শান্তি কোথায়? বিশ্রাম আছে। শান্তি নেই। আমি জানি আমি দার্শনিকের মত কথা বলছি। এখন বলব। কারণ এই মুহূর্তে আমার হাতে কোনো প্ল্যান নেই। এখন ঘুমাতে যাব। ঘুমের আগে আমরা সবাই দার্শনিক। খুনী, ধর্ষক, ঠগ, মিথ্যুক, ছল সবাই। আপনি নন? আপনি ভাবুন। আমি ঘুমাই। আসি।