ছোরি, আমাজন প্রাইমে বেশ কিছুদিন ধরে দেখছিলাম দিয়েছে। ইচ্ছা করছিল না দেখতে, ভূতের সিনেমা আর কি দেখব এখন। কদিন আগে মামু ফোন করে বলল, জানো মামু ছোরি দেখলাম। সে সদ্য ইলেভেনে উঠেছে, আমি ওই বয়সে নিজেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, তবে তো তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, একা একা ভূতের সিনেমা দেখে ফেললি? আমি তো ভয়ে দেখতেই পারছি না।
মামু বলল, হ্যাঁ ভয়ের আছে, তবে সিনেমাটা ঠিক ভয়ের বা ভূতের না, একটা সোশ্যাল মেসেজ আছে, দেখো।
মানুষ যতটা না শব্দে বলে, তার চাইতে বেশি বলে সুরে। মামুর বলার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমায় ছুঁলো। ভাবলাম দেখব। আজ হঠাৎ অনেকটা সময় ছুটি, দেখেই ফেললাম।
প্রথম কথাটাই বলি, মামু ভুল ছিল না। সিনেমাটার জনরা আদৌ সাসপেন্স, হরর শুধু নয়, সিনেমাটা সামাজিক। ভূতের গল্পের আচ্ছাদনে একটা সামাজিক ব্যাধির গল্প, কন্যাভ্রুণ হত্যা। এ সামাজিক ব্যাধিকে হয় তো বাংলায় বসে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা যায় না, এ সেরকম একটা সামাজিক ব্যাধির গল্প। যেটা বাস্তবে গল্প নয়। কাগজে যখন দুদিন আগে পড়লাম এক নীচু জাতের ব্যক্তি উঁচু জাতের ব্যক্তির সঙ্গে বসে নেমন্তন্ন খেয়েছিল বলে তাকে মেরে ফেলা হল, তখন বোঝা যায় ভারতের অনেকগুলো স্তর আছে। প্রধান মাধ্যমের সিনেমায় যদি সে স্তরের গল্প উঠে আসে, অবশ্যই সে প্রশংসার।
সিনেমার খুঁটিনাটি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে রুচি নেই। কিন্তু যদি সিনেমাটার বক্তব্য আমায় ছুঁয়েছে কিনা নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, তবে বলব, হ্যাঁ ছুঁয়েছে। সিনেমাটা যখন শেষ হচ্ছে তখন যে গানটা হচ্ছে নাম দেখাতে দেখাতে, আমি পারলাম না গানটা বন্ধ করে দিতে। গানটা কাঁদিয়ে গেল। তাই সিনেমাটা সার্থক আমার জন্য।
সিনেমাটার বিষয়ে আসি। আমি এ কথা অনেকবার লিখেছি যে যতবার আমি কোনো ডায়গনস্টিক সেন্টারে যাই, যতবার লেখা দেখি যে এখানে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না, ততবার আমার লজ্জায় ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। আমার হাতের স্মার্টফোন, আমার শিক্ষাদীক্ষা, আমার পড়াশোনা - সব কিছু আমায় বিদ্রুপ করে। কি পারলাম? কতটা পারলাম? সত্যিই কি আত্মতুষ্টির জায়গায় আমরা?
মানুষের সব চাইতে বড় দায় তার ভাষার জন্য তৈরি হয়েছে। আমি শরীরে একটা একক মানুষ হলেও, আমার ভাষায় আমি গোটা বিশ্ব তথা অতীত আর ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত। দায়বদ্ধ। আমার ভাষা আমায় এক মুহূর্তে বহু করে। মানুষ বহুর মধ্যে নিজের সার্থকতা খুঁজে পায় সে কেবল ভাষার জন্য। ভাষা আমাদের অস্তিত্বকে বহুধা করে। ভাষাই মানুষের জীবনকে মানুষের জীবন করে। তাই শিক্ষার প্রথম মূল্য লিখতে পড়তে পারা। আপেল কেন মাটিতে পড়ে সে না জানলে জীবন ব্যর্থ হয় না, কিন্তু পাশের মানুষটার ভাষা না বুঝলে, কিম্বা নিজের ইতিহাসকে না জানলে, নিজের সমাজকে না জানলে জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। আর ইতিহাসকে, সমাজকে জানার একটা মাধ্যম অবশ্যই ভাষা। পড়তে, লিখতে না জানলে নিজেকে চিনতাম কি করে? মানুষ তো শুধু একটা পরিবারের উত্তরসূরী হয়ে জন্মায় না, একটা দেশের, একটা সংস্কৃতির উত্তরসূরী হয়ে জন্মায়। সে দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা মানে তো গান্ধারীর মত জীবন বেছে নেওয়া। অজ্ঞের স্বর্গ থাকতে পারে, কিন্তু সত্য থাকে না বলেই সে ব্যর্থ হয়।
ভাষা আমায় সেই দায়ে নিয়ে আসে, যে এই যে কথাটা, ‘ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না’, এর জন্য দায়ী তুমিও যদি না এর বিরুদ্ধে একটা পদক্ষেপও নাও। কতটা পা এগোলো ততটা বড় কথা নয়, যতটা বড় কথা কোন দিকে পা এগোলো। ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণের সমস্যা কোথায়? কন্যাভ্রুণ হত্যায়। একবার লিখেছিলাম আমাদের সমাজে প্রতিটা মেয়ে চোরের মত জন্মায়। নিজের পরিচয় জন্মানোর আগে লুকিয়ে আসতে হয়। তার কারণ ধরেই নেওয়া হয় সে অবাঞ্ছিত। অনাকাঙ্ক্ষিত। আসার আগে তার আসার খবরটা জানা গেলে হয় তো তার আসাই হত না সংসারে।
সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর আমার চারপাশের বাচ্চাগুলোর মুখ মনে পড়ল। আমার দুই মামু, আমার বন্ধুর মেয়ে, যারা আমার খুব কাছের। যাদের ভালো থাকার উপর আমার ভালো নির্ভর করে আজ। তারা যদি না জন্মাতো? যে শূন্যতা তৈরি হত তাকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় কি? মনে আছে আমির খান ‘সত্যমেব জয়তে’ অনুষ্ঠানে এই বিষয়ের উপর একটা এপিসোড করেছিলেন। সারা দেশ তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল দেখে যে উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও কি ভয়ানক অন্ধকার থাকতে পারে দেখে। সত্যিই চমকে যাওয়ার মত সব ঘটনা প্রত্যক্ষ শুনবার অভিজ্ঞতা বোধহয় গোটা দেশের তার আগে এত স্পষ্ট করে ছিল না।
ভারতের কিছু অংশে আজ এ সমস্যা নিশ্চয় আগের থেকে কমেছে। অন্তত আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কিন্তু সিনেমার শেষে যে পরিসংখ্যানটা দেখা গেল সেও ভয়ানক। কথাটা পরিসংখ্যানের থেকে বড়, মানসিকতার। আজও? এ প্রশ্ন আমার মনে জাগে কারণ ভারতের অতিক্ষুদ্র একটা অংশের মধ্যেই আমার চলাফেরা, বাকিটা অন্য গ্রহের জগতের মতই অপরিচিত আমার কাছে। আমাদের চলাফেরার গণ্ডীকে আরো শিকড়ের গভীরে চারিয়ে দেওয়া যায় না?
আমি প্রায়ই দেখি নানা ট্যুর সম্বন্ধীয় গ্রুপে, “একটু নিরিবিলিতে থাকতে চাই এমন জায়গা বলুন”। এ ধরণের খোঁজ প্রায়ই দেখি। মানুষ নিরিবিলি খোঁজে কেন এত? কারণ মানুষ নিজেকে নিয়ে নিজে বয়ে বয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মানুষ কৃত্রিমতায় ক্লান্ত হয়। অতিরিক্ত লোভের, আকাঙ্ক্ষার বোঝায় ক্লান্ত হয়। এক এক সময় মনে হয় এত ক্লান্ত মানুষ আমাদের সমাজে, এত? কেন মানুষ নিজের শিকড়ের খোঁজ করে না? ক্লান্তি থেকে মুক্তি শুধু নির্জন পরিবেশ দেয় কি? রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ এ বলছেন যে, নিজের ভিতর নির্জনতা না পেলে তাকে তুমি কোথাও পাবে না। কোনো গুহায় না, কোনো গভীর অরণ্যে গিয়ে না। আমাদের নাগরিক সভ্যতা আমাদের ক্লান্ত হতে শিখিয়েছে, ক্লান্তিকে উদযাপন করতে শিখিয়েছে, উন্মাদের মত মত্ত হতে শিখিয়েছে, কিন্তু কোথাও যেন আমাদের উজ্জীবিত হতে শেখাতে পারছে না। উজ্জীবিত হওয়ার সহজ উপায় হল, যেখানে যেখানে জীবনের স্রোত অবরুদ্ধ, সেখানে সেখানে মাঝে মাঝেই ঘা মারা, যতটা শক্তিতে কুলায়। জীবনের উন্মুক্ত স্রোতের ধারায় স্নানে ক্লান্তির অপনোদন, সে ক্লান্তির উদযাপন না। এখনও অনেক কাজ বাকি, এত ঘন ঘন ক্লান্ত হলে চলবে আমাদের?
থ্যাংকিউ মামু