এই….এই…দাঁড়াও……
চারদিক শুনশান। রাত গভীর। একটা শতাব্দী প্রাচীন বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে। কে ডাকছে?
সামনে কে? আলুথালু শাড়ি।
আমি….আমি ডাকছি….তুমি যা ভাবছ তাই….আমার বয়েস মানুষের শরীরের হিসাবে আড়াইশো ছাড়িয়েছে….ওই যে একটা বাঁশঝাড় দেখছ….ওখানে একটা বড় দীঘি ছিল। তার ওপারে, রাস্তা ছাড়িয়ে নদী। সেই নদীর উপর সাঁকো তৈরি করবে বলে ওরা এসেছিল…..তাঁবু করে ছিল এদিক ওদিক….আমি…আর আমার স্বামী…যাত্রা দেখে ফিরছিলাম…..ওরা রাস্তা আটকালো….চোদ্দোজন ছিল….পরে জেনেছি… আমার জ্ঞান হারানো চারজনের পর…..স্বামীকে নুলো করে ছেড়ে দিল….আমি মরলাম…নদীতে ভাসিয়ে দিল……জ্ঞান এলো যখন দেখি….গঙ্গায়….ভাসছি….সেদিন ছিল বিজয়ার পরের দিন….আমার গায়ে লাগছে ভাসানো দুর্গার মাথার শনের চুল…..তারপর রাস্তা চিনে চিনে এলাম…..এসো এসো…..আজ আরেকটা হয়েছে….ওইদিকে….বাচ্চা মেয়ে গো…..একা একা বাইরে এসেছিল…..বাহ্যে…..আর সেই সময় ওই মাতালটা…আরে তোমাদের গ্রামের বেলুনওয়ালাটা…লাঠির মাথায় করে বেলুন আটকে নিয়ে ঘোরে….যেন বাচ্চাদের জন্য রঙীন স্বপ্ন বেচছে….আর আজকে দেখো…সেই..সেই পিশাচটা মেয়েটার সব স্বপ্ন এক নিমেষে চুরমার করে দিল…আরে কার কথা বলছি বুঝেছ?…তুমি চেনো…..শালা মদে চুর….মেয়েটাকে ধরল….মেয়েটা বেলুন দেখে এগিয়ে গিয়েছিল গো….আর ওই সুযোগে…..ওদিকে রেললাইনের পাশে ফেলে গেছে…..যাবে? যেও না….গিয়ে কী করবে?.......
বসলে? বোসো। পা চলবে না এখন। কাল ওকে খুঁজে পাবে। দুদিন পর ধরাও পড়বে ওই পিশাচটা। কিন্তু….. কিচ্ছু হবে না জানো….কেন বলো তো?
তোমায় বলতে হবে না….তুমি জানবে না….আমি এই আড়াইশো বছর ধরে মানুষ দেখছি তো….আমি জানি…..আসলে কী জানো মানুষের রক্তে আদিম পিশাচটা মিশে আছে….আমি বই পড়িনি….কিন্তু এই বটগাছের কাছ থেকে জেনেছি অনেক….ওর পাতায় মর্মর ধ্বনি ওঠে….আর এক একটা যুগের গল্প জেগে ওঠে….মানুষের গল্প বলেছে ও….শুনবে?
শোনো। মানুষ যখন পশু থেকে জন্মালো তখন ছোটো ছোটো দল করে থাকত। শিকার করত আর পেট ভরাত। মেয়েরা গর্ভবতী হত….বাচ্চা বিয়োতো….পেশীর জোর তেমন ছিল না…..তাই তারা বাড়িতে থাকতে শুরু করল…আর পুরুষেরা বাইরে…দলপতি হল…এ দলের সঙ্গে ও দলের মারামারি লাগত…লেগেই থাকত….খুনোখুনি হত….তারপর দল বড় হল….রাজা হল….পুরুত হল…..যুদ্ধের পর যুদ্ধ হল….গুহা ছেড়ে, জঙ্গল ছেড়ে শহর গড়ল….কলে বোনা পোশাক পরল….বিজ্ঞানের সাহায্যে যত না ঘর বাঁধার কল গড়ল….মারণ কল গড়ল তার চাইতে ঢের…..
…. কিন্তু কী জানো…সভ্য মানুষের বুকের তলায় সরীসৃপের মত নিঃশব্দ চলনের মত ওই আদিম বর্বর প্রকৃতিটা থেকেই গেল….মাঝে মাঝেই সে নখদাঁত বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে….আদিম গর্জন করে ওঠে….নিঃশব্দে….মানুষ সভ্যতার মুখোশের আড়ালে নিঃশব্দ গর্জন শিখে গেল…..মানুষ এক কথায় কী বলো তো…..সব চাইতে হিংস্র জীব…..মানুষের সব চাইতে বড় ঢাল কী বলো তো….তার ভাষা…..তার গল্প….ঈশ্বর থেকে ভালোবাসা…..সবের গল্প….ভুলিয়ে রাখার গল্প….মানুষ নিজেকে নিজের গল্পে ভোলায়….ভোলেও….কিন্তু সে সরীসৃপ ভোলে না…..
তোমার বিশ্বাস হচ্ছে? আচ্ছা যখন তুমি কোনো বর্বর ঘটনা শোনো….তোমার নিজের বুকের মধ্যে তার ছায়া দেখতে পাও না?..... পাও…পাও…আমরা সবাই পাই….সব বর্বরতাকে চিনি আমরা….আমাদের আদিম রক্তে মিশে আছে…..তাই কোনো পিশাচই আমাদের অপরিচিত নয়….আমাদের সভ্যতার দ্বারা অস্বীকৃত শুধু…..
…. আসলে কোনোদিন মিল হয়নি জানো…..বর্বর স্বভাবটার সঙ্গে… এই শিক্ষিত, মার্জিত তৈরি করা অভ্যাসটার বনিবনা কোন সূত্রে যে হবে….কেউ জানে না। তুমি আইনের পর আইন বানাও….জেলের পর জেল বানাও….যতই সংশোধানাগার নাম দাও….হয় সংশোধন? নাকি তাকে আরেক জাতের চালাকি শিখিয়ে দাও….আরেকজাতের তর্ক শিখিয়ে দাও…নিজের সেই আদিম হিংস্রতাটাকে লুকিয়ে রাখার…..নইলে দেখো…কতগুলো পিশাচ লুকিয়ে একটা মেয়েকে ওইভাবে নারকীয়ভাবে হত্যা করল যেমন….ঠিক তেমনই আরেক দেশে রাষ্ট্রের নামে হাজার হাজার শিশুকে দিনের আলোয় মেরে ফেলছে এমন যে কবর দেওয়ার জায়গা হচ্ছে না….মেয়েদের ধর্ষণ করছে দিনের আলোয়…..অথচ আমাদের সেই মানবিকতার গল্প….সে আদর্শ…. ভূগোলের মানচিত্র আর ধর্ম-সভ্যতার ব্যবধানের পাঁচিল তুলে সব স্বাভাবিক করে নিয়েছে……একে কী বলো? ইন্টেলেকচুয়াল ইতরামি না?
আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কী। কিন্তু সবাই জানি আমরা আসলে কী। তুমি আমি সবাই জানি। কিন্তু অসহায়। আমাদের যন্ত্রণায়, আমাদের বিষাদে, আমাদের অন্ধকারে…আমাদের ঈর্ষায়….ভয়ে….আতঙ্কে…আমরা অসহায়…..। আমরা জানি আমরা কী। কিন্তু আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে। আমরা ভাণ করি তাই। অস্বীকার করি।
…. কিসে অস্বীকার করি? আদর্শ বানিয়ে। আচ্ছা বলো তো….একটা বাড়ি বানিয়ে…কী কিছু শব্দ…কিছু গল্প…কিছু মূর্তি….কিছু ত্রাতা…দেবমানব…উদ্ধারকর্তা….নানা সঙ্কেত…চিহ্ন বানিয়ে সেগুলোকে আমরা ভীষণ পবিত্র কেন বলি?
কারণ আমাদের মধ্যে আসল পবিত্রতাকে আমরা দেখতে পাই না….খুঁজে পাই না….। আমরা ভাবি কোনোদিন কেউ এসে ম্যাজিকের মত সব ঠিক করে দেবে….এই গল্প আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিখিয়ে যাই…..প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চাই….এ সব কি নিজেকে অস্বীকার করার ছল নয়? নিজের মুখোমুখি হতে মানুষের আসল আতঙ্ক। কুণ্ঠা। নয় কি? হ্যাঁ তাই। কারণ আমরা নিজেদের বদলাতে চাই না। সমাজ বদলাতে চাই।
(সে শান্ত হল। রাত কত হল জানি না। তবে মনে হচ্ছে ভোর হতে বেশি দেরি নেই। বাতাসে শীতল একটা ভাব এসেছে। সে অনেকক্ষণ চুপ। ধীরে ধীরে পুবাকাশে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা দিল। সে আবার বলল…)
আমি আসি বুঝলে। তুমিও বাড়ি যাও। যাবার আগে একটা কথা জেনে যাও…..তবু মানুষের মধ্যে একটা নির্দোষ… নির্মোহ…. গভীর সরল সত্য আছে….যা একটা গন্ধ….সে গন্ধটাই মানুষের গভীরতম শান্তির নীড়….তার গভীরে জাগা নীরবতা…..। সে নীরবতা মানে ভাষাহীনতা নয়। সে নীরবতা ভাষাহারা এক অসীম শূন্যতা। সে-ই পবিত্রতা। সে আছে বলেই মানুষের এত কিছু সয়ে যায়। কিন্তু তাকে পাবে কী করে? এত অহংকার… এত উচ্চাকাঙ্খা… এত সবাইকে ছাড়িয়ে নিজেকে সুখী করার তাগিদ….নিজেকে সবার থেকে আলাদা প্রমাণ করার তাগিদ….পারবে? পারবে নিজেকে শূন্য করে সে-ই শান্ত নীরবতার মধ্যে গিয়ে শুদ্ধ হতে? পারবে না। আমি আসি…..তুমিও যাও….চিরাচরিত অভ্যাসে ডুবে যাও….আর মাঝে মাঝে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলো সব বদলে যাচ্ছে….সব সুন্দর হচ্ছে…..এত জোরে বলো যাতে বিশ্বাস হয়….ওই হিংস্র সরীসৃপের পায়ের আওয়াজ শোনা না যায়……
(সে চলে গেল। সূর্য উঠল। প্রাচীন বটগাছটার পাতাগুলোতে মর্মর ধ্বনিতে জেগে উঠল। লাইনের ওদিকে পড়ে আছে এক ধর্ষিতা শিশু। মানুষ আসলে কী? পৃথিবীর সব চাইতে হিংস্র প্রাণী। ভাষা আর বিশ্বাসের সাদা চাদরে ঢাকা। সে জানে সে কী। জানে না কী তার ভবিষ্যৎ। হাত পা ছোঁড়ে। কিন্তু বদলাবে কীসে মানুষ? নিজেকে খালি চোখে দেখায় এত আতঙ্ক তার……)