Skip to main content

পাখিটার বয়েস হয়েছিল। সারাদিন নীড়ে বসে থাকত আর অতীত জীবনের কথা ভাবত। রোজ সকালে চারটে পাঁচটা করে পালক ঝরে পড়ে যেত। পাখিটা সেগুলো জমিয়ে রাখত। রঙগুলো ফ্যাকাসে। পাখিটার মন খারাপ হত।
      একদিন রাতে সেকি ঝড়। মনে হল যেন পুরো পৃথিবীটাই উড়ে যাবে এক্ষুনি। কালো মেঘ একটা বিশাল দৈত্যের মত তার নীড়ের সামনে এসে বলল, দাও।
      পাখি বলল, কি চাও? প্রাণ আমার?
      ঝোড়ো মেঘ বলল, না। তোমার জমানো পালকগুলো।
      পাখিটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল, না!! তার চাইতে তুমি আমায় নাও!
      কিন্তু ঝড় আর কবে কার কথা রাখল। সব পালক উড়িয়ে নিয়ে কোথায় গেল কেউ বলতে পারে না।
      পাখিটা দু'দিন খেল না। মনমরা হয়ে বসে থাকত। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল, কিন্তু আর পালক জমালো না। নিজেই ঠোঁটে তুলে ভাসিয়ে দিত। তার অনেক ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি, এ জঙ্গলে সে জঙ্গলে, তাদের কথা ভাবতে ভাবতে ছড়া বাঁধতে লাগল। তাই তে বেশ বিভোর থাকত সে।
      সেদিন পূর্ণিমা। এত্তবড়ো চাঁদ উঠেছে। সারা আকাশে এক ছিটে মেঘ নেই। পাখিটা ছড়াগুলোতে সুর দিয়ে দিয়ে নিজের মনে গাইছে, আবার কখনও কখনও বুড়ো শরীরটা নিয়ে নাচছেও।
      এক টুকরো সাদা মেঘ এসে পাখিকে বলল, আমায় শেখাবে? পাখি বলল, এই ছড়া তুমি শিখে কি করবে?
      মেঘ বলল, আমার অনেক ছেলেপুলে নাতি-নাতনি এ আকাশ সে আকাশ ভেসে বেড়াচ্ছে, এ ছড়া হয়ত তারা শুনতে পাবে না, কিন্তু আমার প্রাণ জুড়াবে।
      এইভাবে মেঘ, গাছ, বাতাস, আরো কত পশুপাখি সেই ছড়া শিখতে শুরু করল। সবারই কেউ না কেউ দূরে, অনেক দূরে থেকেও তাদের বুকের মধ্যে বিঁধে আছে।
      সেদিন রাতে পাখি এক বিন্দু শিশিরকে তার ছড়া শেখাচ্ছে, হঠাৎ যমদূত এসে বলল, চলো।
      পাখি বলল, আমায় কোথায় নিয়ে যাবে?
      যমদূত বলল, তোমার পালকদের নিয়ে রেখেছি যেখানে।
      পাখি বলল, না না।
      যমদূত বলল, তবে কি একবার নিজের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের দেখতে চাও?
      পাখি একটু দ্বন্দ্বে দুলে বলল, তাও না।
      যমদূত বলল, তবে কোথায় যেতে চাও?
      পাখি বলল, তোমার কেউ কোথাও কোনোদিন হারায়নি দূত?
      দূত বলল, আমাদের সে সব কথা বলতে মানা।
      পাখি বলল, বেশ, তবে এক কাজ করো, আমায় সেখানে নিয়ে যাও, যেখানে আমার ছড়া পৌঁছায়নি আজ অবধি।
      যমদূত বলল, আচ্ছা, আমি খুঁজে আসি।
      সেই যে গেল যমদূত, আর ফিরল না। কিন্তু কাউকে তো অমর করে রাখা যায় না। তাই যমরাজ ঠিক করল বুড়ি পাখি সবার বুকে লীন হয়ে থাকবে ছড়া হয়ে। যে যখনই তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে দুঃখ পাবে তখনই সে গাইবে,

আয় না তোরা আয় না রে।
না দেখে প্রাণ রয় না রে।।
প্রাণের সুধা, চাঁদের হাসি।
তোদের মুখেই যায় ভাসি।।
ছোট্টো আমার নীড়ের প্রাণ।
তোদের সুখেই আমার গান।।
জীবন গেল, পালক গেল।
যম দুয়ারের ডাকও এল।।
ক্ষণেক এসে দাঁড়াস যদি।
নৌকা ছাড়ে জীবন নদী।।
ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাই।
সে সুখের আশায় এ গান গাই।।