Skip to main content

 

যতীনের বাবা পায়খানা করতে গিয়ে হারিয়ে গেল। যতীনের মা শেষ দিন অবধি মাঠে পায়খানা করতে বসে চোখের জল ফেলেছে। তারপর বাড়ি এসে বলেছে, “আমার শরীরটা ভালো নেই। তোর বাবা ফিরে এলে কোনো প্রশ্ন করিস না, খারাপ ব্যবহার করিস না। দুটো খেতে-পরতে দিস।” বলতে বলতে যতীনের মা কেঁদেছে এবং মারা গেছে।

যতীন মাঠে পায়খানা করতে বসে মায়ের কথা ভেবেছে, বাবার কথা ভেবেছে। কখনও উদাস হয়েছে। কখনও মন খারাপ করেছে। কখনও ভেবেছে, দুশ্‌শালা! যতীনের বাবা ফিরল না। কিন্তু যতীন হারিয়ে গেল বিড়ি আনতে গিয়ে।

যতীনের ছেলে নবীন তখন সংসারের ভার নিতে শিখছে। তার মা তাকে বলল, “তুই চলে গেলে এখনই চলে যা বাপ-ঠাকুরদার মতো, আমি সামলে নেব। যা।” নবীন বলেছে, “আমি যাব না কোনোদিন।”

নবীনের বউ আর নবীনের মা নবীনকে চোখে চোখে রাখে। এখন তাদের বাড়িতেই শৌচাগার। সামনেই বড় শপিং মল। বড় বড় ইংরেজি ভাষার স্কুল। কত রকম যানবাহন, কত সুবিধা।

নবীন হারায়নি, তবুও নবীন হারিয়ে গেল। শুধু নবীন না—নবীনের ছেলে, নবীনের বউ, নবীনের মা একই বাড়িতে, একে অন্যের থেকে হারিয়ে হারিয়ে, এড়িয়ে এড়িয়ে।

নবীনের মা এখন দুর্গাপুজোয় ঠাকুরকে ছুঁতে পারে না। মিষ্টির স্বাদে ডুবে যেতে পারে না—সে ময়রারই হোক বা গাছের আম। গায়ে নতুন কাপড় জড়ালে এখন সেই আদর-আদর ভাবটা নেই। ঘুম থেকে উঠে তুলসী-চন্দনের সৌরভের মতো সে সুখটা নেই। অস্থির অস্থির সব। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করে ওঠে।

নবীনের মা একদিন সেই শপিং মলটার সামনে এসে দাঁড়ালো, যেখানে আগে একটা ছোটো মুদির দোকান ছিল—যেখান থেকে তার স্বামী বিড়ি কিনত। আর বিড়ি কিনতে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। শপিং মলের চারদিক ঘিরে সিসিটিভি। নবীনের মা এখন সিসিটিভি চেনে। সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে বলল, “কত দূর পাহারা দেবে?”

নবীনের মা হাঁটতে শুরু করল। যত দূর, যত দূর যায়—কোথাও না কোথাও সিসিটিভি। সবার হাতে মোবাইল। সবাই ছবি তুলছে। একটা গোটা দিনে কত ছবি তোলে মানুষ? সব ছবি কোথায় যায়? এত ছবির ভিড়ে মুহূর্তরা হারিয়ে যায়। হৃদয় তলিয়ে যায়।

নবীনের মা বলল, “তোমাদের সব আছে, মায়া নেই। সব বন্ধ করে একটু নিঝুম হয়ে বোসো। মায়াটা খোঁজো। বেড়া দাও। হারিয়ে যেও না।”

নবীনের মা একটা ব্যস্ত চৌরাস্তায় বাসস্ট্যান্ডে বসে। নবীনের বাবার জন্য অপেক্ষা করে বসে বসে। এত সব বদলে গেল এত তাড়াতাড়ি, চিনতে পারবে? এত ভিড়ে তার আসা কি ভালো? না, ভালো না। সে এলে বাড়িতে কে কথা বলবে? কার সময় আছে? গোটা পৃথিবীজুড়ে একটা অনাত্মীয় নিঃসঙ্গ সিসিটিভি আছে। সে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে দেখে, ফিরে ডাকে না। ওর মায়া নেই যে!