লোকটা সকালে উঠে ভাঁড়ে চা খেত। বেশ আয়েশ করে, পুকুরধারে বসে, সুয্যি ওঠা দেখতে দেখতে, মুরগীর ডাক শুনতে শুনতে, হাঁসেদের জলে নামা প্যাঁক প্যাঁক ডাক শুনতে শুনতে, গরুদের মাঠে চরা দেখতে দেখতে চা খেত। ভাঁড়ে করে চা খেত।
একদিন সে কাগজে কাপের ছবি দেখল। দেখল চা ঢেলে, সেই রঙবেরঙের ফুল আঁকা কাপে করে একজন চেয়ারে বসে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছে।
লোকটার নিজেকে নিয়ে দুঃখ হল। নিজের ভাগ্যের উপর রাগ হল। নিজের শোচনীয় অবস্থার জন্য ঈশ্বরের কাছে নালিশের পর নালিশ জমল।
তার সকালের চা হল তিতো, ভাঁড় হল লজ্জা, সুয্যি হল বাঁকা, মুরগীর ডাক হল কর্কশ, হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক হল অনর্থক, গরুদের মাঠে চরা হল অসভ্যতা। সবাইকে দেখে আর বলে, আহা আমরা বেচারারা! আহা আমি বেচারা!
সে বুঝেছে সে বঞ্চিত। সে বুঝেছে সে অভাগা। সে বুঝেছে তার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। জগতে সুখ আছে অঢেল, কিন্তু সে সবে তার ভাগ নেই! কি আশ্চর্য! একি একচোখা ভগবান, বিধাতা!
কিন্তু এত ভাবলেও হবে কি। কি করবে কিছুই উপায় ভেবে পেলো না। কারণ এতদিনে সে বুঝে গেছে শুধু কাপ নয়, জগতে কাপ থেকে শুরু করে এমন অনেক অনেক সুখ আছে যার থেকে সে বেচারা বঞ্চিত। একমাত্র মূর্খ, অলস আর নির্বোধ মানুষেরাই এই অবস্থায় সুখী হতে পারে। নইলে জগত জোড়া সুখের সাগরে তার নৌকা ভাসবে না কেন?
তার মরে যেতে ইচ্ছা করে আজকাল। কিন্তু নিজের দুঃখকে কার কাছে রেখে যাবে। নিজের থেকেও দামী এখন নিজের এই খুঁজে পাওয়া নিজেকে নিয়ে দুঃখ, শোক। একে কার কাছে রেখে যাবে? সে ছাড়া এর মূল্য কে বুঝবে? তার গভীরে যে এত গভীর নিজেকে নিয়ে দুঃখ করার অবকাশ আছে কেউ জানালো না! হায় হায়! তোরা সুখের ভাগ না দিস, সুখ নেই বলে যে নিজেকে নিয়ে দুঃখ করার আরাম সেটুকুও পেতে দিবি না তা বলে!
সে রোজ রাতে ভাবে আজ সে নিজেকে শেষ করে দেবে। দড়ি নিয়ে কাঁঠালগাছটার নীচে বসে। রাত ঘনায়। তার মনের মধ্যেও নিজেকে নিয়ে হাজার একটা দুঃখ করার নেশা চড়ে। কাঁদে। চোখের জলের আলপনা আঁকে। সে জলে শুধু তার নিজের অধিকার। নিজের নাম লেখে। নামের আগে 'বঞ্চিত' শব্দটা লেখে। সুখে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হয়। সে নিজের ঘরে দোর আটকে চৌকিতে শুয়ে পড়ে, নিজেকে নিয়ে শোক করে। সারা মাথা ঝিম ধরে আসে। সুখ পায়।
একদিন ফুস করে সে মরে গেল। সত্যি সত্যিই মরে গেল। কাঁঠালগাছটা চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে। যেন আকাশ থেকে নামা সাদা চাদরে ঢেকে সাজিয়ে দিচ্ছে কে তাকে! ছোটো ছোটো ঘাসফুলগুলো অবধি চাঁদের আলোয় ফুটে উঠেছে। পুকুরে চাঁদের ছায়া পড়েছে। টলটল করছে সে ছায়া। মুরগী, হাঁস, গরু সবাই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। শুধু ঘুম নেই ঝুলমাখা চায়ের ভাঁড়ের। সে বুঝতেই পারল না কেন তার বন্ধু তাকে ছেড়ে গেল, কি দোষ ছিল তার! সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে, কি হল! দেখতে দেখতে জানলার ফাঁক দিয়ে তার গায়েও এসে পড়ল একফালি চাঁদের আলো। ঝুলে লাগা চাঁদের আলো যেন তার গলায় পরালো মুক্তামালা।সে মুগ্ধ হল। বন্ধুর জন্য জমা দুঃখকে চাঁদের আলোর হাতে তুলে দিয়ে বলল, একে তুমি নাও, তোমার আলোয় ও থাকুক উজ্জ্বল, আমার বন্ধুর আগের মুখের মত, সেই দেখেই আমি হব সুখী।