Liberal শব্দটা জন্মেছে ল্যাটিন liber শব্দ থেকে, যার অর্থ free, অর্থাৎ মুক্ত। আর flexible শব্দটা এসেছে ল্যাটিন flectere শব্দ থেকে, যার অর্থ, to bend, নমনীয় হওয়া।
একজন মুক্তচিন্তক আর একজন নমনীয় মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কী? একজন মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। কোনো সামাজিক রীতিনীতিতে বিশ্বাস করে না। কোনো অথোরিটিতে আস্থা রাখে না। সে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে চায়। কিন্তু এসব সে গর্বের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে তাও নয়। সে নিজেকেও নিজের অথোরিটি মানে না। সে নিজের চিন্তাভাবনার নানাবিধ সীমাবদ্ধতা (limitations), সংস্কার (conditionings), পক্ষপাতিত্ব (biasness) ইত্যাদি নিয়েও সচেতন। সে জানে মানুষ এক্কেবারে মুক্ত হতে পারে না। আর কোথাও না হলেও নিজের স্বভাবের ঝোঁকের কাছে (innate nature) অসহায়। কিন্তু সে সবের থেকে নিজেকে মুক্ত করে দাঁড়াতে চায়। অনেকটা ১৯০৩ সালে প্রকাশিত বার্ট্রান্ড রাসেলের A free man's worship বইয়ের আদর্শের মত। সে জানে এক্কেবারে মুক্ত হওয়া অসাধ্য ব্যাপার, কিন্তু তাও সে যতটা পারা যায় প্রাণপণে করতে চায়।
আরেকজন মানুষ তার জন্মলব্ধ সমাজব্যবস্থা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদিকে অস্বীকার করে না। কিন্তু কোথাও তাকে নির্ভুল, ধ্রুব বলেও মানে না। তার সমাজের প্রথা, ধর্মের বিশ্বাসই একমাত্র ঠিক আর বাদবাকি সব ভুল, এ কথা সে বলে না। সে নমনীয়ভাবে দেখতে চায় নিজের বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতাকে। সে জানতে চায় নিজের নানাবিধ মূল্যবোধের পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য ধারার ধর্ম বিশ্বাস, সমাজ বিশ্বাসের প্রথাগুলোকে। সে নমনীয় বলেই তার অমতের, তার বিশ্বাসের বিপরীত বাস্তবকে সে তুচ্ছ করে না। হেলা করে না। সে প্লুরালিজমে বা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী হয়। সহনশীলতায় বিশ্বাসী হয়। গ্রহণে বিশ্বাসী হয়।
একজন স্বার্থবুদ্ধিহীন বা অন্যভাবে বললে, কোনো মতলবহীন মানুষের মুক্তচিন্তক হওয়াতে, কী নমনীয় হওয়াতে সমাজের লাভ। কিন্তু স্বার্থবুদ্ধিতে উদার সাজলে, কী নমনীয় সাজলে, সিউডো-লিবারাল, কি সিউডো-ফ্লেক্সিবল সাজতে গেলে তীরে এসে তরী ডুবে যায়। সমাজের ভীষণ ক্ষতি তাতে।
ভারতের নবজাগরণে প্রাচীনকে নমনীয় করে নবীনের সঙ্গে মেলাবার প্রচেষ্টা হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের যা কিছু সঙ্কীর্ণ, ভেদবুদ্ধিতে দুষ্ট, সেগুলোকে সরিয়ে রামমোহন রায় ভারতকে একটা নতুন আলোয় দেখার চেষ্টা করেছিলেন। উপনিষদের সত্য রামমোহনের নানাবিধ ধর্ম-দর্শনের প্রভূত পাঠের মণিমাণিক্যে নতুন আলোয় দেখা দিয়েছিল। তার আগেও ভক্তি আন্দোলনের যুগে একই ঘটনা ঘটেছিল যদিও। শাস্ত্রের কাঠিন্য ভেঙে তাকে মানুষের হৃদয়ের কাছে আনার চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। নানক, কবীর, চৈতন্য, দাদু প্রমুখেরা সেই একই সাধনার পথের পথিক।
সক্রেটিস সেদিনের সমাজের ধর্মবিশ্বাসকে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু নিজের চিত্তের মুক্ত ভাবনাকে সে সবের দ্বারা জড় করে ফেলেননি। মূল সত্যটাকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, নিজেকে জানাই মানুষ হয়ে জন্মানোর প্রধান কাজ। ঘাতেপ্রতিঘাতে, আনন্দে-বিষাদে, সফলতা-ব্যর্থতায়, জীবন-মৃত্যুতে ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে দিয়ে নিজেকে চিনতে হবে। এ এক অসীম পথ। কোনোদিনই সম্পূর্ণ নিজেকে জানা হবে না। কিন্তু নিজেকে জানা ছাড়া নিজেকে শান্ত করার, সার্থক করার আর কোনো উপায় নেই। আছে কি?
একজন মুক্তচিন্তক মানুষ অনেকটা লড়াই করার পর বুঝতে পারে, সে বাইরের সব ধর্মীয়, সামাজিক, নানা প্রাতিষ্ঠানিক অথোরিটিকে অস্বীকার করলেও, নিজের বোধের সীমাবদ্ধতা, সংস্কার আর ত্রুটিপ্রবণতা থেকে মুক্তি কোনোদিন পাবে না। ঠিক তেমনই একজন নমনীয় বিশ্বাসী মানুষও বুঝতে পারে অন্যান্য ধর্ম আর সমাজের বিশ্বাসের সঙ্গে তার ধর্ম-সমাজের তুল্যমূল্য বিচার, সহনশীল আদানপ্রদান ইত্যাদিরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তারপর?
মুক্তচিন্তার সীমাবদ্ধতা আর নমনীয়তার সীমাবদ্ধতায় পৌঁছে, দুজন মানুষই দুদিক থেকে একই শূন্যতার সামনে এসে দাঁড়ায়। যে শূন্যতার আরেকটা নাম humbleness. যে humble শব্দটা ল্যাটিন humus শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ভূমি বা মাটি।
অবশেষে মাটিই সত্য, সে তার বুকে রক্তমাংস হাড়মজ্জায় মিশে গিয়েই হোক, অথবা পুড়ে ছাই হয়ে তার বুকে পড়েই হোক। অবশেষে মাটিই সত্য। এই নিজেকে জানার ভিত্তিভূমি।