প্রচণ্ড জোরে চড় মারল। দুলটা কান থেকে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ল। রাস্তার এদিকটা অন্ধকার থাকে। আজ নেই। এ বাড়ি, ও বাড়ি কালীপুজোর জন্য আলোয় আলো। রাস্তায় যেন হাজার একটা জোনাকি বসে আছে। তার মধ্যে ছিঁড়ে পড়ল দুলটা। চোখে জল এলো অজান্তে। ব্যথায় না, যন্ত্রণায়। এর মধ্যেও মনে এলো গানটা, ঝুমকা গিরা রে বেরিলিকে বাজার মে....মানুষের মন.... মন তুমি কার?
আজ লোক আছে রাস্তায়। কয়েকজন দৌড়ে এলো। কলার চেপে ধরেছে। তার বরের। সে কিছু বোঝার আগেই একজন মুখের উপর ঘুষি চালিয়ে দিল। তার বর কিছু বলল না। কিন্তু সে প্রাণপণ আটকাতে চাইছে। চীৎকার করছে। তাদের বাইকটায় লাথি মারল কেউ একজন। বাইকটা রাস্তার ধারে পুকুরে পড়তে পড়তেও আটকে গেল। একটা গাছের গোড়ায় লেগে। সে গলার শিরা ফুলিয়ে চীৎকার করছে, ছেড়ে দিন.... ছেড়ে দিন ওকে….প্লিজ….
শোনা যাচ্ছে না। বিল্লোরাণী....কহো তো আভি জান দে দো.....ও বিল্লোরাণী....। প্রবল জোরে গানটা বাজছে। কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। কেউ কারোর কথা শুনতে পাচ্ছে না। মারের পর মারে সে শুয়ে পড়েছে। তার কানের দুলটা গুঁড়িয়ে গেল। কারুর পায়ের চাপেই গুঁড়িয়ে গেল।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে তার বরকে ছাড়ল সবাই। কেউ বলল, শালা উচিৎ শিক্ষা হল। যে যার মত চলে গেল। তার বর কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালো। বাইকটা দাঁড় করালো। বসল বাইকে। সেও গিয়ে বসল। বসে আরেক দিকের কানেরটা খুলে রাস্তায় ফেলে দিল।
বিকাশের মা সুইসাইড করেছে। মেন্টাল অ্যাসাইলামে। বিকাশ যাবে না দেখতে। ও নিতে পারে না। ওর নিজেকে মনে হয় ওর মায়ের রোগটা ওতে চারিয়েছে। ও সব সময় সন্দেহ করে। সব কিছুকে সন্দেহ করে। মাঝে মাঝে সান্ত্বনাকে জড়িয়ে কাঁদে। বাচ্চার মত কাঁদে। ও কোনো বাচ্চা নিতে চায় না। বাচ্চা হলে সেও মেন্টাল অ্যাসাইলামে মারা যাবে। বিকাশের বাবা নেই। ছোটোবেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। একমাত্র বোনটাও সুইসাইড করেছে গায়ে আগুন দিয়ে। বিয়ের ছ মাসের মধ্যে। সংসারে সবাই কি সবার মত সুস্থ হয়?
বাইকটা লক করল না। বাইরে রেখেই ঘরের তালা খুলল। সোজা বাথরুমে চলে গেল। সান্ত্বনা বসার ঘরে সোফায় বসে। মাথাটা টিসটিস করছে। দুটো কান জ্বালা করছে। বাথরুম থেকে শাওয়ারের জল পড়ার আওয়াজ আসছে।
বিকাশ বেরোলো আধঘন্টা পর। নীল টাওয়েলটা কোমরে। সারা গায়ে, পিঠে, গালে কালশিটের দাগ। আরো দাগ আছে নিশ্চয়ই। সান্ত্বনা কাঠ হয়ে বসে। তাকাচ্ছে না আর। সাহস হচ্ছে না। সামনের জানলা দিয়ে ও বাড়ির ছাদে বাজি পোড়ানো দেখছে। তাদের গোটা বাড়িটায় আগুন লেগে যাচ্ছে না কেন? সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে না কেন?
আসলে বিকাশের কাকিমারা বারবার ফোন করছে কাল রাত থেকে। “কেন পুলু শ্মশানে এলো না রে”....”কেন মুখাগ্নি করল না”....”কাজটা তো তিনদিনে করবে তো?”.....”তোর বাবা অনেক আস্কারা…..নইলে এ বাড়ির ছেলে”......
আজ ধৈর্য রাখতে পারেনি। বিকেলে বিকাশ বলল, সামনের উইকেণ্ডে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। আমাদের অফিসের সনাতনদা নিজেই দিলেন। বৌদি দেখান। স্কিজোফ্রেনিয়া আছে। এখন ভালো আছে। তুমি যাবে সঙ্গে?
সান্ত্বনা সন্ধ্যেবেলায় বিকাশের সঙ্গে বাইরে বেরোলো। বাইরের জগতে এত আলো, এমন উৎসবের আমেজ, তার হঠাৎ মনে হল যেন সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তিনদিনের কাজটা করলে হয় না? কথাটা বলল রেস্টুরেন্টে। এই নিয়ে কথা-কাটাকাটি শুরু হল। সান্ত্বনা থেমে যেতেই চেয়েছিল। কিন্তু জিভ থামে না। আগেও দেখেছে। যেখানে থামার সেখানে বুদ্ধি থেমে গেলেও জিভ থামে না। নিজেকে যে সে এতটা ডিপ্রাইভড ভাবে সেটা সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল। মনে হয়েছিল যা হবে হোক….রিয়েলিটিটা ওকে বুঝতেই হবে… কেন সে-ই শুধু সব স্যাক্রিফাইস করবে?....কিন্তু সবার রিয়েলিটি কি এক?
রাতে শুতে এসে একটা কথাও বলল না বিকাশ। চোখটা লেগে এসেছিল সান্ত্বনার, হঠাৎ কানে এলো বিকাশের গলা, ইউ আর অলসো আ পোটেনশিয়াল রেপিস্ট……পোটেনশিয়াল রেপিস্ট…..
নিজেকে নিজে বারবার বলে যাচ্ছে বিকাশ। সান্ত্বনার সারা শরীর বেয়ে হিমের স্রোত বয়ে গেল। কিছু বলবে সে?
কিভাবে বলবে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে, বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙল অ্যালার্মে। যোগা ক্লাসে যায় রোজ। সাড়ে ছ'টায়। তার অ্যালার্ম।
ঘুম ভাঙল। সদ্য ভাঙা ঘুমের ক্ষণিকের স্বস্তি মুহূর্তে ভেঙে গেল। সব মনে পড়ে গেল। পাশে বিকাশ নেই।
বিকাশকে পেল বসার ঘরে। সিলিং এ ঝুলছে। কাল রাতের খাবারগুলো ফ্রিজ থেকে বার করে খাবার টেবিলে রেখে গিয়েছিল সান্ত্বনা, এসে গরম করবে বলে। সেগুলো খাবার টেবিলে রাখা। মেঘ করে আছে। বাইরেটা অন্ধকার অন্ধকার। বিকাশের দিকে তাকালো। গামছাটা ঠাকুরঘরের। ঠাকুরের পট মুছতে ব্যবহার করে। নীল শর্টসটা এবারের পয়লা বৈশাখে কিনেছিল। খালি গা। কালশিটের দাগ।
সান্তনার কী যেন মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে না যেন কিছু। একজন অস্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে সেও কি স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে?
সান্ত্বনা উঠল। রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় কাপ ফিল্টারের নীচে ধরল। জল ভরল। ওভেনটা অন করে চায়ের পাত্রটায় জলটা বসালো। সামনের বাড়ির ফ্ল্যাটে গায়ত্রী মন্ত্র চলছে। রোজ চলে। আজ বড্ড নিরর্থক লাগছে। মানুষের বোকামির শেষ নেই।
জল ফুটল। কফি দু চামচ গুলল কাপে। ওভেন অফ করে কফিটা নিয়ে বিকাশের সামনে বসল। আর কতক্ষণ দেখতে পাবে সে? তারপর? পোস্টমর্টেম হবে না? তারপর? সাদা চাদরে ঢেকে নিয়ে আসবে। কী পরাবে? পুজোর লাল পাঞ্জাবিটা? ওর পছন্দ হয়েছিল।
কফির কাপটা অর্ধেক ফাঁকা। টেবিলে রেখে বিকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জড়ালো বিকাশেকে। বিকাশের নাভিতে, পুরুষাঙ্গে, পায়ের পাতায় চুমু খেল। সব মানুষ কি সব মানুষের মত করে সুস্থ হয়? সবাই বোঝে সবাইকে?
হঠাৎ কানে হাত দিল। আরেকটা কানের দুল ফেলে এসেছে রাস্তায়। বিকাশ কিনেছিল অনলাইনে। তার জন্মদিনে। শেষ উপহার। আনবে না? পড়ে থাকবে রাস্তায়? ওর দাম কে বুঝবে?
রাস্তায় বেরিয়ে এলো সান্ত্বনা। গায়ে খয়েরী ছোপ ছোপ নাইটিটা, আর ঘরের চটিটা পায়ে। দরজায় তালা দিল। হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। কতক্ষণ লাগবে, আধঘন্টা? একঘন্টা? দেড়ঘন্টা?.... থাকতে পারবে না ও একা? আর কী করবে? আর তো ভয় নেই। কিন্তু ও রেপিস্ট না। কোনোদিন ওর ছোঁয়ায় অস্বস্তি হয়নি সান্ত্বনার। বিয়ের আগেও না, যখন ভয় থাকে বেশি। কিন্তু দুলটা?
মেঘলা আকাশ। সান্ত্বনা হনহন করে হাঁটছে। বারবার কানে হাত দিচ্ছে। কানটা এত ফাঁকা লাগছে কেন আজ? এত ফাঁকা কেন?