দৃশ্য - ১
মশারির বাইরে অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরছে। ইচ্ছা ভিতরে আসে। গায়ে বসে।
কিন্তু কেন? কারণ খিদে। আমি আছি বলেই ও বেঁচে। আমার রক্তের জন্যেই ওর জন্ম।
বটকৃষ্ণ ভাগবতটা মুড়ে রাখলেন। এও কৃষ্ণের জীব। কিন্তু আমিষে মতি। তার শরীরে মতি। কি করবেন? তিনি কি নির্দয় হচ্ছেন? তিনি রক্তদান শিবিরে যান না। সূচের ভয়। রক্তদানে চাঁদা দেন অবশ্য হাত খুলে। এখন কি করবেন? দেবেন, অল্প?
দৃশ্য ২
বটকৃষ্ণ নার্সিংহোমে। ডেঙ্গু। কৃষ্ণনাম করছেন। ডেঙ্গু শরীরে কেন? ডেঙ্গুর ভাইরাস তার শরীরে এসেছে কৃপা করে বংশবিস্তারের জন্য। সেও কৃষ্ণের সৃষ্টি। তার শরীরের মধ্যে যদি লক্ষ লক্ষ ভাইরাসদেহী প্রভু জন্মায় ক্ষতি কি?
দৃশ্য ৩
বটকৃষ্ণের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ভক্তকে নারায়ণের দূত গোলকে নিয়ে এলেন। বটকৃষ্ণ নারায়ণকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠেই দেখেন নারায়ণের পাশে জ্বলছে গুডনাইট।
বটকৃষ্ণ বললেন, প্রভু! এ আপনার কি লীলা? জীবকে অভয়দানই আপনার লীলা যে প্রভু!
নারায়ণ বললেন, ওহে ভক্ত, তোমার শুদ্ধ শরীরের রক্ত পান করে, অনেক মশাই দেহত্যাগের পর এই স্বর্গকূলে স্থানান্তরিত হয়েছেন। সবই চিত্রগুপ্তের হিসাবের ফল। যত বলি ওরে মেশিনটা আপডেট কর, উইণ্ডোজ টেন লাগা। কে শোনে কার কথা! তো সেই স্বর্গের মশাদের গুঞ্জনে আর দংশনে আমাদের শান্তি বলে কিছু নাই ভক্ত। অগত্যা মর্তলোক হতে এই আনা হয়েছে।
ইতিমধ্যে মশা মারার ব্যাট হাতে নারদের প্রবেশ। ভক্ত করজোড়ে প্রণাম সারলেন। নারদ নারায়ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি?
নারায়ণ বললেন, ইনিই তিনি নারদ, যার জন্য তোমার হাতে ব্যাট আর আমার পাশে গুডনাইট।
ভক্ত লজ্জা পেলেন। এহে কাজটা তো তবে ভালো হয়নি। নারদ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ভক্ত, শাস্ত্রে রিপুর কথা ছ'টা বলা হয়েছে। এই বলে নারদ ক্লাসে পড়া বলার মত করে ছ'টা রিপুর নাম বলে যেতে লাগলেন, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য। তোমার জন্য আরেকটা যোগ হল বৎস, মশকীদংশন। কাম ক্রোধের জ্বালা সামলে তবু সাধন করা যায়। কিন্তু ওহো.. হো হো… এ মশকীর দংশনে তো আর মালা ফেরে না হাতে। এই দেখো বাদ্যের জায়গায় ব্যাট। কি বলব, উর্বশীরা অবধি নাচের তাল কেটে ফেলছে, মৃদঙ্গবাদক মশা তাড়াতে গিয়ে যেখানে সেখানে সমে এনে ফেলছে। মহাদেবের গায় রাতদিন নন্দীভৃঙ্গী ওডোমস মাখাচ্ছে। বলি কাণ্ডজ্ঞান কি কিছুই নেই গো!
বটকৃষ্ণ প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। তিনি বললেন, তা প্রভু আপনি এ সব গুডনাইট, মর্টিন জ্বালান সে কথা আমাকে আগে বলবেন না?
নারায়ণ, ঠপাস করে একটা মশাকে মেরে বললেন, আরে বাবা এত এত অসুর মারলাম, ভাগবতে লেখা হল, আর এই মশাদের ছেড়ে দেব? এরা কি জগতের শান্তিভঙ্গকারী নয়?
কিন্তু প্রভু আপনার লীলায় তো কোনোদিন মশারি নামটা শুনিনি। সে তো আমরা জালজাল এক জড়বস্তুকে জানি। কি মায়ায় যে ঘোরাও প্রভু!
নারদ বললেন, যা হোক, যা করেছ, করেছ, যাও হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও, তারপর মশা তাড়ানোর গাড়ি বেরোচ্ছে, তার সাথে ধামে ধামে ঘোরো বুঝলে?
বটকৃষ্ণ যে আজ্ঞে বলে বেরোতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, আজ্ঞে একটা প্রশ্ন ছিল। এই যে আপনি আর প্রভু পটাপট মশাদের লীলাসাঙ্গ করছেন, এদের এর পরের গতি কি হবে?
নারদ বললেন, কি আর হবে? আবার জন্মাবে।
বটকৃষ্ণ বললেন, আবার মশা হয়ে?
নারদ বললেন চিত্রগুপ্তের কাছে যাও।
দৃশ্য ৪
চিত্রগুপ্ত মশারির মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। কার্ড পাঞ্চ করে বটকৃষ্ণ ঢুকতেই ব্যাজার মুখ করে চিত্রগুপ্ত বললেন, কি চাও? কি মনে করে?
বটকৃষ্ণ যতটা সম্ভব বিনয় দেখিয়ে বললেন, আজ্ঞে এই সব মশাকূল স্বর্গ থেকে তাড়িত হয়ে কোথায় যাচ্ছে?
চিত্রগুপ্ত নাকের কাছে চশমাটা নামিয়ে বললেন, হে হে প্রশ্নটা খাসা। কিন্তু উত্তরটা সহ্য করতে পারবে?
বটকৃষ্ণ বললেন, তা প্রভুর আশীর্বাদে সহ্য হয়েই যাবে…
চিত্রগুপ্ত বললেন, এ সবকে প্রতি জন্মে তোমার স্ত্রী রূপে একে একে পাঠানো হবে। মশারির মধ্যে ডেকে আনো তো! এবার থেকে আগের থেকেই ঢুকে থাকবে। তোমায় আর সাধ করে ডাকতে হবে না….
বটকৃষ্ণের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বুকের কাছটা ধড়ফড় করছে। নেহাত একবার দেহত্যাগ হলে আরেকবার দেহত্যাগ করার জো নেই বলে কিছু হল না। তবু ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, তারপর?
চিত্রগুপ্ত চশমাটা আবার স্বস্থানে তুলে বললেন, তারপরের ঘটনা তারপরেই হবে… আপাতত তোমার জন্য রাখা ঘরে যাও। দশ বছর, আটমাস, দু’সপ্তাহ, চারদিন, দু’ঘন্টা, বারো মিনিট, চোদ্দো সেকেণ্ড পরে তোমার জন্ম হবে ভবানীপুর কৃষ্ণ মন্দিরের ধারে এক ভক্ত পরিবারে। এবং তোমার সে জন্মের স্ত্রী জন্মাবে কেষ্টপুর খালের ধারে এক ফেমিনিস্ট পরিবারে। জয় মাধব। জয় মহাদেব। এসো, যাওয়ার সময় তোমার জন্য বরাদ্দ ওডোমশ নিয়ে যেও।
(বটকৃষ্ণ সম্পূর্ণ স্বর্গবাসকালে একটি কথাও নাকি এরপর আর উচ্চারণ করেননি। এখন থেকেই তিনি নাকি নীরবে থাকার অভ্যাস শুরু করেছেন নিন্দুকেরা বলে।)