Skip to main content

কি বলব তোমাদের! আমি সেদিন মাস্কটাস্ক পরে, বাজার করে ফিরছি, হঠাৎ স্কুলের বাইরে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনি কি হট্টোগোল! এদিকে আমি তো জানি সব স্কুলটুল বন্ধ। তবে? হঠাৎ করে সব খুলে গেল নাকি? তোমরা বললে বিশ্বাস করবে না, একটু উঁকি দিয়ে তাকিয়ে তো আমার চক্ষুচড়কগাছ! স্কুলের মাঠে সব বেড়াল, কুকুর, গরু, কাক, শালিখ, মুরগী, হাঁস --- সবাই মিলে প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে। দশটা কি বারোটা কোকিল মিলে গান গাইছে, আর সবাই মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি চমৎকার প্রার্থনা গাইছে! "আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন"...

    আমি তো তাজ্জব। লোভ সামলাতে না পেরে ঢুকতে গেছি, ও বাবা! কোত্থেকে একটা দাঁড়কাক দিল আমায় মাথায় ঠুকরিয়ে, বলল, এই চশমা পরা লোক, তুই কেন ঢুকছিস?

    আমি থতমত খেয়ে বললাম, আরে আমি মাস্টার তো। আমি এই দেখতে এলাম যদি তোমাদের কোনো কাজে লাগি।

    কথাটা আমি কিন্তু মিথ্যা বলিনি জানোতো, আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই মাস্টার।

    কাকটা সব শুনে বলল, বেশ, আগে আমাদের প্রার্থনা হয়ে যাক, আমি হেডমাস্টারের সঙ্গে তোমার কথা বলিয়ে দিচ্ছি।

    আমি বললাম, কে গো তোমাদের হেডমাস্টার?

    অমনি কাকটা একটা ইয়াব্বড় ষাঁড়কে দেখিয়ে দিয়ে বলল, উনি। দূর থেকেই পেন্নাম করো।

    আমি হাত জোড় করে দূর থেকেই প্রণাম করলাম। হেডমাস্টার আমার দিকে তাকিয়ে দু'বার শিং নাড়িয়ে দিলেন।

    আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন প্রার্থনা শেষ হয়। প্রার্থনা শেষ হল। হেডমাস্টার বলল, আজ এই মানুষের দুর্দিনে আমাদের ওদের পাশে থাকতে হবে বুঝলে ছাত্রছাত্রীগণ? সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। হেডমাস্টার আবার বললেন, এসো আমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করি।

    বললে তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, এমনকি হনুমানগুলো অবধি স্থির দাঁড়িয়ে থাকল! বাপ রে বাপ! এও হয়!

    যা হোক, কাক আমায় হেডমাস্টারের ঘরে নিয়ে গেল। হেডমাস্টার আমায় বসতে বললেন চেয়ারে। উনি আর নিজে চেয়ারে বসবেন কি করে? অগত্যা আমিও দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, ঠিক আছে, আপনি বলুন, আমি দাঁড়িয়েই শুনছি।

    ষাঁড় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কি পড়াবেন?

    আমি বললাম, যা যা বলবেন।

    হেডমাস্টার মাথা নেড়ে বললেন, তা পারিশ্রমিক কত নেবেন?

    আমি মহাফাঁপড়ে পড়লাম। এরা আবার টাকা কোথা থেকে পাবে যে আমায় মাইনে দেবে?

    আমি বললাম, ঠিক আছে, ও আমি এমনিই না হয় পড়িয়ে দেব।

    হেডমাস্টার মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ধুর, তাই কি হয় নাকি। ওতে শিক্ষা অপূর্ণ হয়। ঠিক আছে, আমরা তো টাকা দিতে পারব না, বরং আপনাকে মধু আর দুধ প্রতি মাসে দিতে পারব। আমাদের ছাত্রছাত্রীরাই দিয়ে আসবে।

    আমি, যে আজ্ঞা বলে ফিরতে যাব, উনি বললেন, সেকি আপনি ক্লাসে যাবেন না?

    আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, না মানে, আজ তো কিছুই আনিনি।

    হেডমাস্টার বললেন, ঠিক আছে, ও আমরা সব জোগাড় করে দেব। আপনি ক্লাসে যান।

    আবার কাক এসে গেল। আমায় নিয়ে মাঠে পৌঁছে দিয়ে গেল। এই হল নাকি ক্লাস! আমি মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, তা আজকে আমরা কি পড়ব?

    বেড়াল বলল, আজ আমরা মাছ কি করে বাড়িতে চাষ করা যায় সেটা পড়ি?

    অমনি একটা গরু লাফিয়ে বলল, না না, মোটেই না। আমরা বরং কোন ঘাসে অম্বল কম হয় সেইটা পড়ি।

    ছাগল বলল, ধুর... সে তো সোজা, আমরা ছাগলেরাই বুঝতে পারি, আর তোমরা জানো না? কি আহাম্মক গরু রে বাবা!

    অমনি একটা গরু বলল, এই ছাগল, আমাদের আহাম্মক বলবি না, জানিস না তোদের নিয়ে মানুষেরা গালাগাল দেয়?

    ছাগল বলল, সে তোমাদের নিয়েও কম কথা বলে না!

    প্রায় শিঙাশিঙি লেগে যায় আর কি। হঠাৎ একটা গাধা এসে বলল, তার চাইতে কত মণ চাল আমার পিঠে চাপালে আমি ঘন্টায় দেড় কিলোমিটার বেগে হাঁটতে পারি সেই হিসাবের কয়েকটা অঙ্ক কষে নিলে হয় না?

    কাক বলল, না, আমরা আমাদের ডাকের মিষ্টত্ব আনার শিক্ষা চাই।

    মুরগী বলল, আমরা রঙিন ডিম পাড়ার কৌশল শিখতে চাই।

    শালিখ বলল, আমরা সুইমিংপুল বানানো শিখতে চাই।

    সব মিলিয়ে একটা মেলা হট্টগোল লেগে গেল। সেই শুনে ষাঁড়, মানে হেডমাস্টার এসে বললেন, চুপ চুপ! একদম চুপ!

    সবাই চুপ করে গেল। হেডমাস্টার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি বরং ওদের একটা গান শেখান।

    যেই না বলা, অমনি সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ গান হোক, গান হোক।

    আমি ভাবছি কি গান শেখানো যায়, হঠাৎ আমাদের পাড়ার হুলোটা আমার কাছে এসে বলল, আরে 'হও ধরমেতে ধীর' গানটা শেখাও না! কাল তো নাইবার ঘরে গাইছিলে, আমি তোমাদের একটা ভাজ মাছ রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে দেওয়ালে বসে খেতে খেতে শুনছিলাম। বাব্বা, একটা ভাজা মাছের জন্য আমায় তো ফাঁসিই দিয়ে দিচ্ছিলে তোমরা। যা হোক, তুমি হও ধরমেতে ধীর শেখাও।

    ফস করে একটা শেয়াল মিচকে হেসে বলল, টুম্পাসোনাও শেখাতে পারো।

    অমনি কি হাসির রোল পড়ে গেল। হেডমাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, আপাতত ওসব গান থাক, মাস্টার যে গান শেখাচ্ছেন তাই গাও তোমরা।

    এই বলে হেডমাস্টার আমার কানে কানে এসে বলে গেলেন, আপনি একটু ক্লাসরুমের জানলার দিকে এগিয়ে এসে গান, ওই বদ্ধ রুমগুলোর মধ্যে অনেক পেঁচা, বাদুড় রয়েছে, ওরা তো রোদে বেরোতে পারে না জানেন। তাই আর কি!

    তোমাদের কি বলি ভাই, যেই না আমি প্রথম লাইনটা গেয়েছি, ওরা এমন বিকট স্বরে সব চীৎকার করে উঠল, যে আমারই প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়! ওরা নাকি কোরাসে অমনি গায়! আসলে তো গানটা ওদের মনের মত হয়নি। তাই অমন বেসুরো চীৎকার করতে শুরু করে দিল সব।

    এদিকে এতসব হইহুল্লোড় শুনে কোত্থেকে একটা পুলিশের গাড়ি চলে এল। আসবে না? লকডাউন চলছে যে! তা যেই না পুলিশ এসেছে, অমনি সব পশুপাখি যে যেখানে পারল লুকিয়ে গেল। মাঠে আমি একা দাঁড়িয়ে। একজন পুলিশ এসে আমায় জিজ্ঞাসা করল, এই ঠাঠা রোদে মাঠে দাঁড়িয়ে কেন? আমি কি বলি বলো, বললেই কি ওরা বিশ্বাস করবে? আমি বললাম, এই খোলা মাঠে একটু গান করছিলাম আরকি।

    পুলিশ হেসে বলল, গান? এই মাঠে, লকডাউনে, একা একা? আচ্ছা পাগল তো আপনি? আচ্ছা বেশ শোনান তো দেখি….

    আমি ভয়ে ঘাবড়ে আসল গান ভুলে যেই না 'ও টুম্পাসোনা দুটো হাম্পি দেনা' গেয়ে ফেলেছি…. অমনি যে যেখানে ছিল লাফ দিয়ে বাইরে এসে মাঠের মধ্যেই নাচ শুরু করে দিল। আহা! তোমরা যদি সত্যিই পুলিশের মুখটা একবার দেখতে। সে তো প্রথমে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেই না তার হাবিলদার একটা হনুর সঙ্গে হাত ধরে নাচতে লেগেছে, অমনি সে ভয়টয় ভুলে মোবাইল বার করতে লেগেছে, বলে কিনা ফেসবুকে লাইভ দেখাবে। যেই না সে ভিডিও তুলবে বলে মোবাইল অন্ করেছে, অমনি একটা হনুমান এসে ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে বলল, দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে চার ডজন কলা দিয়ে তবে এটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবি বুঝলি?

    তারপর শুরু হল কি নাচ আর গান! ওদিকে 'আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে' গান শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ গাইছে -- গাছে গাছে হনু নাচে, কত ছাগল চারিপাশে...

    পুলিশ তো গাড়ি নিয়ে পালালো। আমিও বাইরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছি, হঠাৎ কাক এসে বলল, যাচ্ছ যাও, কিন্তু আমাদের নিয়ে একটাও বাজে কথা যদি ফেসবুকে লিখেছ না, দেখাব মজা…, আর শোনো আমাদের ইনস্টাগ্রামে সব ছবি আপলোড করব… একটা বাজে কথা যদি লিখেছ না….

    আচ্ছা বলো, এই যে আমি লিখলাম, একটাও বাজে কথা লিখেছি বলো? তবে তোমরা যদি চাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো আমি সেই স্কুল থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব তোমাদের। আর তোমরা একান্ত যদি না স্কুলে যেতে পারো তবে একটু ছবি এঁকে, গান গেয়ে, আবৃত্তি করে, দুষ্টুমি করে আমাকে জানিও, আমিও ওইসব অল্প অল্প তোমাদের থেকে শিখে নেব। বিশেষ করে দুষ্টুমি করাটা একদম ভুলে গিয়ে শরীর মন একদম বুড়োটে হয়ে যাচ্ছে। সময় করে আমায় সব জানিও কিন্তু হ্যাঁ? আজ তবে আসি। টাটা। ভালো থেকো। আর খেলায় আর পড়ায় দুটোতেই থেকো।