Skip to main content

 

মনু মিস্ত্রি। জেল থেকে যখন বেরোলো বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর। জেলের বাইরে এসে মনু নিজের দিকে একবার তাকাল। কী ভাবল বলতে পারি না। তারপর হাঁটতে শুরু করল। এমন স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে যেন বাজার করতে এসেছিল, বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

মনুর বয়েস এখন ষাটের কাছাকাছি। তার যখন পনেরো বছর বয়েস তখন তার কোনো আত্মীয় তাকে লুধিয়ানা স্টেশানে ফেলে চলে যায়। মনু জড়বুদ্ধি সম্পূর্ণ না হলেও, সংসারে চলনসই নয়। ফলে বাপ মা মরা ছেলেকে কে রাখবে? কিন্তু সেই বাংলা থেকে লুধিয়ানা কেন সে আত্মীয় তাকে রাখতে এল, এর স্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই।

মনু এখন থাকে বেণারসে। কেন জেল হয়েছিল মনু জানে না। পুলিশ আধিকারিকেরা জানে। অনেক সময় কারণ উপযুক্ত হয় না, কিন্তু দায় পড়ে, বাধ্য হয়ে আনতে হয়। আর সে ক্ষেত্রে মনু উপযুক্ত পাত্র। তাকে জেলে আনতে, ছাড়তে কারোর কোনো বেগ পেতে হয় না। মনু তার আস্তানাও বদলায় না। পুলিশের তাই খুঁজে পেতেও বেশি বেগ পেতে হয় না।

মনু মিস্তিরি কী করে হল সে গল্পটা কিছুটা জানি। লুধিয়ানাতে যখন স্টেশানেই পড়েছিল, না খেয়েদেয়ে দুদিন, এক কাঠ মিস্তিরির চোখে পড়ে সে। মনুর চেহারা চিরকালই ভালো। মানে বেশ উন্নত। বাঙালিদের এমন চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না। সেই লুধিয়ানাবাসী মিস্তিরি মনুকে বাড়ি নিয়ে যায়। কাজ শেখায়। মনু যতটা সাধ্য শেখে। সুক্ষ্ম কাজে মনু অতটা দড় ছিল না। কিন্তু যে কোনো ভার টানার কাজে সে অপ্রতিরোধ্য। তার মনিব শুধু না, পাড়ার সবাই সে কথা বুঝে গিয়েছিল। ফলে অল্প দুটো ভালো খাবারের বিনিময়ে মনু গায়েগতরে যতটা পোষাত তার চাইতে অনেক বেশি খেটে দিত।

তার মনিব একদিন মারা গেল। হঠাৎই। মনুর বুদ্ধি যতই শাখাপ্রশাখাহীন সরু লিকলিকে সংসারে অচল হোক, হৃদয় তো ছিল। সে কাঁদল না। সেই দিন এক পোশাকেই বাড়ি ছাড়ল, পাড়া ছাড়ল, লুধিয়ানা ছাড়ল, কাশীতে এসে পৌঁছাল।

আজকের দিনে ফিরে আসি আবার। মনু জেল থেকে বেরিয়ে একটা পাবলিক টয়লেটে ঢুকল। পয়সা দিয়েই ঢুকল। সঙ্গে একটা চটের ব্যাগ, তাতে কী আছে সে-ই জানে। সেটাকে যে পয়সা নিচ্ছিল তাকে ইশারায় বলল দেখে রাখতে। মনু বাক্য গঠন করতে পারে না। তাই কথা কম বলে। এই ষাট বছরের জীবনে সে অন্তত এতটা স্পষ্ট বুঝেছে কী করলে সে উপহাসের পাত্র হয়, আর কী করলে না।

বাইরে বেরিয়ে এসে চায়ের দোকানে ঢুকল। দুটো পাউরুটি আর চা বহুক্ষণ ধরে খেল। খেতে তার তৃপ্তি লাগছে, না বিরক্তি সে মুখ দেখে বোঝার জো নেই। বাইরে এসে তার আস্তানার দিকে এগোল। আস্তানা বলতে একটা ফ্লাইওভারের নীচে, রাস্তার ধার ঘেঁষে রাখা রাজ্যের এটা সেটা জড় করা কয়েকটা কাপড়ের পুঁটলি। পুলিশ কৌতুহলবশত অনেকবার ওগুলো খুলেছে। এতবার খুলেছে আর ছড়িয়েছে যে রাস্তার কুকুরগুলো অবধি ফিরে তাকায় না। আর মনু? সংসারে যে কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হওয়া সে বহুকাল হল ছেড়ে দিয়েছে।

মনু আস্তানায় না গিয়ে গঙ্গার ধারে এসে বসল। বিকেলের রোদটা পড়তে শুরু করেছে। পাঁচিল ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন মধ্যরাত। তার থেকে দুহাত দূরে একটা কুকুর শুয়ে। গঙ্গায় জোয়ার এসেছে, পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ হচ্ছে। পাড়ে বাঁধা নৌকাগুলো দুলছে। মনু চিৎ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুলো। মনু কী ভাবে? পরিবারের কথা? মনুর শরীর জাগে না? হৃদয় চায় না কাউকে? এত নিস্তেজ একজন মানুষ হয় কী করে? এক এক সময় মনু গোঁ ধরে হাঁটতে থাকে। এই শুধু ওর বিকার। কিন্তু এত অল্প বিকার এমন একজন প্রায় অপ্রকৃতিস্থ মানুষের হয়ই বা কী করে? জানি অনধিকার চর্চা করছি, তবুও। সংসারে শিক্ষিত, ভদ্র মানুষের নানাবিধ অদ্ভুত বিকার দেখে দেখে অভিজ্ঞতা তো কম হল না। তবে মনুর মনে কী চলে?

মনু উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মুখ থেকে অর্থহীন কিছু শব্দ উচ্চারণ কর‍তে করতে জলে ঝাঁপ দিল। ভয় নেই। মনু সাঁতার জানে। ভালোই জানে।

=======

দরিয়া সিং এর বউ সকালে উঠে দরজায় জল দিতে গিয়েছিল। সেখান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ঘুমন্ত দরিয়াকে ধাক্কা দিতে দিতে বলে, আরে ওঠো…. ওঠো তো একবার…. দেখো বাইরে কে এক পাগল এসেছে…. কী সব বলে যাচ্ছে….

দরিয়া উঠল। টলতে টলতে বাইরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দেখে উসকোখুসকো এক পাগল। চেহারাটা চেনা। মুখটাও। কে? কে তুমি? কী চাও?

জিভটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মনু মিস্তিরি বলল, আপনার বাবা যে বাটালিটা দিয়ে আমাকে কাজ শিখিয়েছিলেন, সে বাটালিটা আমার লাগবে। ওটা চাই।

দরিয়া চিনতে পেরেছে। তার বাবা যখন মারা যায় তার বয়েস ছিল এগারো, মনুকেও ভালোই চিনত। কিন্তু এতকাল পরে!

দরিয়ার বউ বলল, বাবার জিনিসগুলো তো গোছানোই আছে, তুমি ওকে ঘরে ঢুকিও না, ব্যাগটা হরিওমকে বলো এনে রাখুক, ওর যা লাগবে নিয়ে যাক। আমার ভয় করছে। হরিওম দরিয়ার ছেলে।

দরিয়া দরজাটা খুলে বলল, ভেতরে এসো।

বাইরের ঘরের দরজার কাছে বসল মনু। হাজার বলতেও দরজাটা পেরিয়ে ভেতরে এল না। দুটো হাত ভিক্ষা চাওয়ার মত করে বলতে লাগল, ওই বাটালিটা…..

দরিয়ার শরীর ভালো না। তাও নিজেই গিয়ে বাবার ব্যাগটা এনে সামনে রাখল। এ কাজ এ বাড়িতে আর কেউ করে না। দরিয়া কলেজে পড়ায়। হরিওম ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে।

মনু ব্যাগটার মধ্যে মাথাটা ঢোকালো। ব্যাগের গন্ধটা প্রাণভরে নিল। তারপর হাতড়ে হাতড়ে বাটালিটা বার করল। চুমু খেল। দুই চোখে ছোঁয়ালো। দুই চোখের জলে বাটালিটা ভিজে গেল। দরিয়ার চোখেও জল। তার বউ বলল, ওকে বসতে বলো, খেয়ে যায় যেন।

মনু বসল না একদণ্ড। বাটালিটা নিয়ে বাড়ির দরজায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে সজল নয়নে বলল, যাই। তোমরা ভালো থেকো।

কথায় আছে মানুষ তার শেষ সময় এলে নাকি বুঝতে পারে। মনুও কী বুঝেছিল সেই জানে।

লুধিয়ানা স্টেশানে বাটালিটা বুকে ধরে সারাটা দিন রাত বসে থাকল। খেল না। এমনকি জল অবধি না।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু মনু মিস্তিরি মারা গেল লুধিয়ানা স্টেশানে না। মারা গেল আম্বালার জেলে। হিমগিরি এক্সপ্রেস যখন লুধিয়ানায় এল তখন শেষ রাত। মনু জেনারেল কামরায় উঠল। উঠতে গিয়ে একজনের গায়ে পা লেগে গিয়েছিল। মনুর অনিচ্ছাকৃত সেই অপরাধ, মনুর শরীরের ভারে প্রবল হয়ে দেখা দিল। কজন বিহারি ছেলে ফিরছিল। তাদেরই একজনের গায়ে মনুর পা লেগেছিল। সে উঠেই মনুকে চারটে চড় মারল গালে। মনু কিছু বলল না। কিন্তু মারার একটা নেশা তো আছে। মনুর মত প্রবল মানুষ যখন নীরবে মার সহ্য করে হয় তো সে নেশা আরো চাগিয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই হল। জেনারেল বগিটায় এমনিতেই অনেকে বসার জায়গা পাচ্ছিল না। তায় গুমোট গরম। সেখানে আচমকা এরকম একটা দৃশ্যপট তৈরি হতে অনেকেই চোখের কোণে লেগে আসা কয়েক বিন্দু ঘুমকে উৎখাত করে জমিয়ে বসল। যে যার মাতৃভাষায় বলতে লাগল, মারুন দাদা, আরে চুপ আছেন কেন….চালান হাত….চেহারাটা তো জব্বর…. আরে হিজড়া নাকি….

মনু চুপ। সব উস্কানিতেই চুপ। সংসারে উস্কানির অভাব কোনোকালেই ছিল না। সে ভালো-মন্দ যে কোনো অজুহাতেই হোক, কয়েকজন লোক চিরকাল মানুষকে উস্কিয়ে উস্কিয়েই সমাজের তথাকথিত উপকার করে চলেছে।

এত অত্যাচারের মধ্যেও কদিন না খাওয়া মনু বুকের কাছে বাটালিটা চেপে ধরেছিল। একজনের চোখ গেল সেই বাটালির দিকে। সেটাকে টানা হ্যাঁচড়া করতেই মনু গর্জে উঠল। যে কজন এর মধ্যেও বগির মধ্যে এত চেঁচামেচি আর দুলুনি উপেক্ষা করে ঘুমাচ্ছিল তারাও চমকে উঠে পড়ল। এবং গোটা ঘটানাটার প্রেক্ষাপট বোঝার আগেই দেখল একজন উদভ্রান্ত পাগল তার হাতের অস্ত্রটা একজনের বুকে বসিয়ে দিল কবজির সবটুকু জোর দিয়ে। রক্তে ভেসে গেল তার জামার উপরের তিনটে বোতাম খোলা লোমশ বুক। বাকিরা হতভম্ব হয়ে দূরে সরে গেল। গোটা বগি জুড়ে আর্তনাদ। সাইড লোয়ারের লোক কজন উঠে পালাতে, জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। মনু বাটালিটা হাতে নিয়ে সিটটায় শুয়ে পড়ল। সিটে বাটালি চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মনু ঘুমিয়ে পড়ল।

আম্বালা জেলে মনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। কিন্তু জীবনের আর কতটুকু অবশিষ্ট সে বিচারক জানবেন কী করে। মারা গেল বছর না ঘুরতেই। মনু খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিল। মাঝে মাঝেই বাটালিটার জন্য কেঁদে উঠত। আকাশের দিকে হাত তুলে বলত দাও, দাও দাও। জেলের কুঠুরির মধ্যে তার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছেই ফিরে আসত। মনু উবু হয়ে বসে মাটিতে মুখ গুঁজে কাঁদত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

কেউ কেউ বলে মনুকে দাহ করার সময় নাকি জেলারের চোখে জলের রেখা দেখা গিয়েছিল। উনি নাকি আসল বাটালিটা মনুর চিতায় দিয়ে একটা নকল বাটালি খুনের অস্ত্র হিসাবে সংরক্ষণাগারে রেখে দিয়েছিলেন। হতে পারে। সংসারে সব জল তো মরীচিকা নয়। তবে মানুষের আগে ঈশ্বরই ছাতি ফেটে আত্মহত্যা করতেন।

মনুর গল্প এখানে শেষ। আরো অনেক অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করছে পাঠক। কিন্তু থামি, সংযত হই। মানুষ যে দিনের শেষে নিজেকে নিয়ে কী একা, কী অসহায়, এ কথা লেখার পর লেখা লিখে লিখেও কোনোদিন কি শেষ করতে পারবে মানুষ? জানি না। যদি দরদী হও পাঠক, তবে জানিয়ে যেও, তোমার কী মনে হয়?