আত্মবিশ্বাস কী আত্মাতেই জন্মায়? মানে নিজেতেই জন্মায়? উঁহু।
আমাদের সমাজে নানা কুসংস্কার আছে। কী করে টিকে আছে? কারণ সে কুসংস্কারগুলো “অনেকেই” মেনে চলে বলেই আছে। উদাহরণ দিতে গেলে প্রচুর বড় লেখা হয়ে যাবে। জ্যোতিষী থেকে শ্রাদ্ধসংস্কার ইত্যাদি ইত্যাদি যে নিয়মাদি আছে, সেগুলো “অনেকে” মানে বলেই আছে। একজন মানুষ মারা গেল। তার শ্রদ্ধায় কিছু মানুষ জমায়েত হল, এর মানে বোঝা গেল। কিন্তু তাকে বৈতরণী পার করানোর জন্য এত এত বিধিবিধান দিয়ে যেতে হবে, এবং নানা কাল্পনিক দোষের জন্য এত এত বিধান দিয়ে যেতে হবে, এ প্রথা কেন টিকে আছে? “অনেকেই মানে” বলেই আছে।
আঙুল ভর্তি আংটি, গলায় জাত্যাভিমানের ধ্বজা ওড়ানো পৈতে ইত্যাদির সগর্বে থেকে যাওয়ার কারণ কী? কারণ ওই এক, “অনেকেই মানে”।
এ শুধু কুসংস্কার এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে না। নানাবিধ দুর্নীতির ছারপোকাও এই “অনেকেই তো করে” র বুদ্ধিতেই হয়ে যাচ্ছে। একজন আপিসে গিয়ে দেখল অনেকেই ঘুষ নেয়, অনেকেই ফাঁকি দেয়, অনেকেই এটাসেটা করে যা করা উচিৎ না। কজন আর সেই “অনেকের” থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে চাইবে? এমনিতেই “অনেকের” দিকে একটা টান তো এসেই পড়ে। নানাবিধ দুর্নীতি করার দুঃসাহসটাও তাই এই “অনেকে করে” আছিলাতেই হয়ে যাচ্ছে।
আবার “কেউই তো করে না” এই যুক্তিতেও অনেক কিছু অনেকের করাও হয়ে ওঠে না। ভালো বই, ভালো আলোচনা, ভালো উদ্যোগ এমন অনেক কিছু চাইলে অনেকেই করতে পারে। কিন্তু করে না। যেমন একটা উদাহরণ, লাইব্রেরীর প্রায় অবলুপ্তি দশা। “কেউ-ই তো যায় না”। “কেউ-ই তো পড়ে না”। এসব যুক্তির আছিলায় আর নতুন কিছু করে ওঠা হল না। শুধু বই পড়া না। ভালো জিনিসের চর্চা, দুটো সিরিয়াস খবরের কাগজ পড়া, দুটো ভালো সাক্ষাৎকার শোনা, দুটো কবিতার বই কেনা কী দুটো ভালো কবিতা নিয়ে আলোচনা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক কিছুই চাইলেই করা যেত, কিন্তু করা যাচ্ছে না, কারণ “অনেকেই তো করে না”।
এইভাবে নানাবিধ অসংগত জিনিস করা আর নানাবিধ ভালো জিনিস না করার পেছনে যে আত্মবিশ্বাস সেটা তবে কোত্থেকে এলো? না পরিবেশ থেকে। চারপাশ থেকে। একে আত্মবিশ্বাস কেন বলছি? কারণ বিশ্বাসের বিপরীত যে শব্দটা - সংশয়, তার কোনো লক্ষণই তাদের আচরণে নেই বলে। কিন্তু তারা এটা জানে না, তাদের সবটাই যে আত্মবিশ্বাসে দাঁড়িয়ে, সে “আত্ম” সত্তাটা সমাজের একটা এলোমেলো ছবিমাত্র। ভীষণ ভাসাভাসা। শক্তি নেই, আস্ফালন আছে। সত্যের গভীর অবধি শিকড় নেই, নানা আশঙ্কা আর ভয় জট পাকিয়ে আছে।
এর বাইরে একটা সত্যকারের আত্মবিশ্বাস হয়। যা অর্জন করতে হয়। যা সব সময়ই সতর্ক, উন্মুক্ত, আপাত দৃষ্টিতে অত দৃঢ় না, কিন্তু শিথিলও না। যা বোধগম্য, সংগত আর ভালো। তাকে নিজের যুক্তি, কাণ্ডজ্ঞান, বাস্তবতার বোধ, জ্ঞানের দিকে নিজেকে খোলা রেখে অর্জন করতে হয়। সেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। সমালোচিত, নিন্দিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতাংশ। কিন্তু নিজের প্রবৃত্তির উপর নির্ভর না করে যদি বোধের উপর দাঁড়ানো অভ্যাস করা যায়, তবে তা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে। স্বভাবের অংশ হয়ে ওঠে। বাচ্চা যেমন একদিনে দাঁড়াতে শেখে না, তেমন একদিনেই এই স্বনির্ভরতা আসে না। কারণ বাধাটা বাইরে তো নয়। আমার মধ্যেই। আমার ভয়, জড়তা, দুদিক রেখে চলার ইচ্ছা ইত্যাদি কী কম!
মানুষ বদলালে সমাজ বদলায়, না সমাজ বদলালে মানুষ বদলায়, এর কোনো এক বাক্যে উত্তর হয় না। তবে দুটোই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের সমাজে ব্যক্তিস্বতন্ত্রতাকে অনেক ক্ষেত্রেই স্পর্ধার চোখে দেখা হয়। সেখানে অনেকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা সার্ভাভাইল স্ট্র্যাটেজির মধ্যেই পড়ে। স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু একজন মানুষের বাকি থেকে যায়। খাঁচার পাখির গল্পেই মানুষের গল্প শেষ হয় না। বনের পাখির আধখানা ডানা তারও আছে। তাকে সুচতুরভাবে নানা গল্পে সে কথা ভুলিয়ে দেওয়া হয় সে অন্য কথা। কিন্তু তবু সে আছে।