এখন অতিথি মানে তো আর অ-তিথি না। সেলসম্যান, চাঁদাম্যান ইত্যাদিরাই অ-তিথি। বাকি অতিথির আনাগোনা আর কই? নিজের লোকই বাড়ি আসার কারণ খুঁজে পায় না, তো দূরের লোক।
মোদ্দাকথা তিথিহীন আগমন নেই আর। দু'দিন আগে ছটপুজোর দিন দুই বৃদ্ধ গল্প করছেন, সন্ধ্যেবেলা চায়ের দোকানে বসে... বলছেন, আচ্ছা, ওদের যেমন ছটপুজোয় এত এত বিশেষ ট্রেন দেওয়া হয় দিল্লি, বোম্বে, আমেদাবাদ.. এইসব জায়গা থেকে... বাঙালিদের দুর্গাপুজোয় কী এইভাবে এত এত পুজো স্পেশাল ট্রেন দেওয়া হয়? এইভাবে মারামারি করে বাঙালিরা ট্রেনে ওঠে বাড়ি ফেরার জন্য? বাড়ি ফেরার তাগিদ এইভাবে পদপিষ্ট হয় বাঙালিরা?
আমি শ্রোতা। চায়ের দোকানে কত কথাই তো হয়। ওসব নিয়ে তর্ক করতে নেই। ওসব যুক্তির কথা তো নয়, এমনি এমনিই কথা। নইলে এইবারে পুজোয় এয়ারপোর্টে কত রেকর্ড 'ফুটফল' হয়েছে খবরের কাগজে বেরিয়েছে না? তারা আবার সার বেধে পরিযায়ী পাখির মত এয়ারপোর্টে ভর করে উড়ে গেছে তাও তো বেরিয়েছে। বাঙালিরা কী আর যে সে কাজ করে এদেশ ওদেশ? তাদের জন্য থোড়ি অমন শামিয়ানা খাটাতে হয় স্টেশানের বাইরে? তারা কত আগে রিজার্ভেশন করে প্লেনে, ট্রেনে। মোট কথা বাঙালিদের আবেগের মূল্য আলাদা। সে একটা ক্লাসে বিরাজমান। এই তো ক'দিন ধরে বাঙালি উচ্চমানের বুদ্ধিজীবীরা কি সুন্দর ছটপুজো, ঠেকুয়া নিয়ে মজা-তামাশা করা পোস্ট দিচ্ছিল। বুদ্ধিজীবীরা শ্রমজীবীদের অকৌলিন্য নিয়ে তামাশা করবে, নইলে ওদের কথা ভেবে রাজনীতি করবে, এই তো প্রথা। নইলে সমান সমান ভাবার কী মানে? তাই কী ভালো লাগছিল পোস্টগুলো দেখে। সত্যিই তো, আমার শিক্ষা, আমার উদারতা অন্যকে ছোটো, অপাঙক্তেয় করে দেখানোর মত করে যদি বড় না-ই হল, আন্তর্জাতিক না-ই হল, তাহলে চুনকালি অমন মান-খ্যাতির মুখে।
যা হোক, সেই বৃদ্ধ দু'জন বলছিল, তাদের পরিচিত কারা কারা ফিরে এসেছে পুজোয়। চা শেষ হল, কিন্তু তাদের গল্প শেষ হল না।
একজন উঠতে উঠতে বলল, উঠি, তোমার বৌদির ইচ্ছা হয়েছে আজ মোমো খাবে। খাক্। গোটা পুজোটা তো বুড়ো-বুড়ি একাই কাটালাম।
আরেকজন বৃদ্ধ বললেন, শীতে তো যাও.... এবার যাবে না?
দেখি.....
একরাশ অভিমান ছুঁড়ে রেলের কারখানার পাশ দিয়ে সাইকেলটা গড়িয়ে দিল। অন্ধকারে মিশে গেল সাইকেল। গেট পড়ছে। ট্রেন আসবে।
আরেকজন বৃদ্ধকে চাওয়ালা বলল, যাও.... চোখে তো ভালো দেখোও না.....
সে বলল, হ্যাঁ রে যাই..... কিন্তু ওর তো তাও অপেক্ষা করার লোক আছে.... আমার তো....
শেষের কথাগুলো সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। আমি জানি উনি এমনিই আমার দিকে তাকালেন। একা মূল উৎপাটিত মানুষ যে কোনো মানুষের দিকে তাকিয়েই নিজের কথা বলতে পারে। কিন্তু মনে হল এতক্ষণের সব কথা যে শুনছিলাম সেটাই যেন ধরা পড়ে গেছি। আমি তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। উনি সাইকেলটা ধরে দাঁড়িয়ে। বলছেন, গেটটা উঠুক... আপ শান্তিপুর মনে হয়..... যাক, যাচ্ছি....
ফিরতে চাইছে না। বুঝলাম। এতবড় জীবনের, এত সংগ্রামে, শখে, ইচ্ছায় বানানো সংসারেও মানুষের একদিন ফিরতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই, নইলে যাবে কোথায়? আর ভাঙাবাসার, ডানাভাঙা মানুষের জায়গা কোথাতেও হয় না। সে কি ও নিজেও জানে না?