Skip to main content

 

009.jpg

 

কাল থেকে তো অনেকেরই চোখে পড়েছে, তিনজন বিজ্ঞানী মেডিসিনে নোবেল পেলেন। এই গোটা হপ্তা জুড়েই নোবেল দেওয়া হবে। গতকাল যে কারণে তারা নোবেলটা পেলেন সেটা শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে আমার বারবার ক্লাস নাইন/টেনে পড়া আমাদের জীববিজ্ঞান বইয়ের মেণ্ডেলের মুখটা ভেসে আসছিল। আমাদের অনেকেরই হয় তো মনে আছে তাকে বংশগতিবিদ্যা, জেনেটিক্স এ সবের জনক বলা হয়। অথচ ভাবুন, এই মানুষটা দু-দুবার শিক্ষক হওয়ার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন? কী আশ্চর্যের না? গোটা বিশ্বের শিক্ষকেরা যাকে পড়ান আজ, জেনেটিক্সের জনক যিনি, কী সব অসাধারণ সব কাজ যা হয়ে চলেছে তা নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে, সে-ই তিনিই নাকি দুবার ফেল করলেন? শিক্ষক হতে পারলেন না?

হ্যাঁ, এমনই অদ্ভুত ইতিহাস মেণ্ডেলের। ১৮২২ সালের ২০জুলাই এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এখন সে গ্রামটা চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে পড়ে। গ্রামের নাম হেইজেনডর্ফ। বাবার চাষের কাজে সহায়তা করতে শুরু করেন। কিন্তু গ্রামের এক পুরোহিতের চোখে পড়ে যান। তিনি মেণ্ডেলের বাবাকে বলেন ওকে ভালো করে পড়াশোনা করাতে। বাবা স্কুলে ভর্তি করে দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ১৮৪৩ সালে মোটামুটি পড়াশোনা শেষ করেন। এর মধ্যে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে হয় যদিও। এক অর্থনৈতিক কষ্ট তো ছিলই যার জন্য গৃহশিক্ষকতা করতে হত। তার উপর শরীর! আজীবন মেণ্ডেলকে অসুস্থ শরীর ভীষণ ভুগিয়েছে। নীৎশে, দস্তভয়েস্কি অনেকেই অবশ্য স্নায়বিক অসুস্থতায় ভুগেও কীসব অসামান্য কাজ রেখে গেছেন, যা আজও গোটা বিশ্বের কাছে মৌলিক ও পথপ্রদর্শক। যা হোক, মেণ্ডেল দুবার বাড়িও ফিরে আসেন অসুস্থতার কারণে। তবুও হাল ছাড়েননি। অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মঠে যোগদান করেন। মোদ্দা কথা খাওয়াপরার ঝক্কিঝামেলা থেকে রেহাই পেয়ে যাতে নিজের বিদ্যাচর্চার কাজে মনোনিবেশ করা যায় তার জন্যেই যোগ দেন। আর এইখানেই তার সামনে এক বিরাট সম্ভাবনার দিক খুলে যায়।

তখন মঠে শুধু যে ধর্মীয় অতীন্দ্রিয়বাদ চর্চা হত তাই না। মোটামুটি একটা বৌদ্ধিক চর্চার সমাবেশও হত। ফলে মেণ্ডেল অনেক বিদ্বান মানুষের সংস্পর্শে আসেন। ওর জ্ঞানের জন্য খিদেটা আরো গভীরভাবে চাড়া দেয়। মেণ্ডেল অনেকের নজরেও আসেন। ওকে অস্থায়ী শিক্ষকতার ভার দেওয়া হয় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করতে করতে ওর মনে হয় এটাই ওর জন্য সঠিক রাস্তা। কিন্তু “কী ছিল বিধাতার মনে”। দুবারই শিক্ষকতার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন। শেষে আর সব দিক ছেড়ে মঠে পাকাপাকিভাবে থাকবেন ঠিক করলেন। কিন্তু জ্ঞানতৃষা যাবে কোথায়? এ শখের বিজ্ঞানীও নয়, দায়সারা চাকুরে বিজ্ঞানীও না। এ তো খাঁটি তৃষ্ণার্ত মানুষ! তখন তিনি মনোনিবেশ করলেন মঠের সামনের জমিতে। মনে হল, সেখানে যে গাছগুলো আছে সেগুলো নিয়ে যদি পরীক্ষানীরিক্ষা করা যায় হয় তো ফলন বাড়ানো যাবে, কিছু সুরাহাও হবে তার পরিবারের। তখন যদিও কেউ কেউ বংশগতিতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন, কিন্তু হালে পানি পাওয়া যাচ্ছিল না।

মোটামুটি ১৮৫৪ থেকে কাজ শুরু করে ১৮৬৫ সালে প্রথম নিজের কাজ প্রকাশ করেন। প্রায় ২৮,০০০ গাছের উপর কাজ করে ফেলেন। কিন্তু তার কাজের ফলাফলে খুব একটা আমল কেউ দেয় না। তার একটা বড় কারণ হয় তো বা মেণ্ডেলের কাজে স্ট্যাটেসটিকস’এর উপস্থিতি। আসলে মেণ্ডেলের প্রিয় বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা ও গণিত। ওর শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন ডপলার, যার নামে ডপলার এফেক্ট। অগত্যা সে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে গণিতের উপস্থিতি তো থাকবেই। আর সেটাই হল তদানীন্তন মানুষদের কাছে বাধা। তখন সে ধারণাটা একদম আনকোরা ছিলই বলা চলে। লোকে বুঝতেই পারে না যে গাছপালার বংশবিস্তারের সঙ্গে এত আঁক কষাকষির কী আছে বাপু!

ইতিমধ্যে মেণ্ডেল মঠের সর্বেসর্বা হন। আর শুরু হয় আরেক লড়াই। সেই সময় সরকার ঠিক করেন মঠ থেকেও কর নেওয়া হবে। মেণ্ডেল বেঁকে বসেন। তিনি বলেন, মঠ ঈশ্বরের কাজের জায়গা। ঈশ্বরের থেকে কর! নৈব নৈব চ! ব্যস শুরু হয় লড়াই। মেণ্ডেলের উপর ভীষণ চাপ পড়ে। কিডনির গোলমাল দেখা যায় ও ১৮৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি মারা যান। পরে ১৯০০ সালে হুগো দ্য ভ্রিস প্রমুখ বিজ্ঞানীর হাতে ওর কাগজ আসে ও মেণ্ডেলকে পুনরাবিষ্কার করে।

আমাদের বাচ্চাগুলোকে যদি বোঝানো যায় যে কোনো ব্যর্থতা, কোনো অবস্থাই আদতে জীবনের শেষ অঙ্ক নয়, আরো আরো অনেক অনেক উপায়ে জীবনের দাঁড় বাওয়া যায়, তবে সেটা একটা কাজের কাজ হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানের পাঠক্রমে মস্তিষ্কের গণনায় তো অনেক আমরা। অনেকের ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান = সহজে চাকরি/ সমাজে মানসম্মান। আগ্রহ নেই, তাগিদ নেই। ঠেলা আছে। ফলে ঠেকায় পড়ে সিলেবাস এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে যেন আর কোনো বৌদ্ধিক দায় নেই। যতটুকু মেধা নিয়ে সে এসেছে, সেটাকে কেটেছেঁটে সিলেবাস অনুযায়ী বানিয়ে দিলেই শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান খুশি। কিন্তু তাই কি উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার? বিজ্ঞানটাকে ধরাবাঁধা মুখস্থের প্রণালীতে পড়ে যাওয়ায়র ফল যা হয় তাই হচ্ছে। পাঠ্যবই = অর্থনৈতিক লাভ। এ বাস্তব। কিন্তু নিজেকে আলোকিত করতে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও কিছু লাগে। সে পড়াশোনাই আসল পড়াশোনা। যে পড়াশোনা আমাকে ভাবতে শেখায়, তৃষ্ণার্ত হতে শেখায়, আমাকে সত্যনিষ্ঠ করে তোলে মহত্বের পারিতোষিকের আশায় নয়, জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলার প্রেরণায়, সেই হল আসল শিক্ষা। কিন্তু এ কথা বলবে কে? রিল? সোশ্যাল মিডিয়া? কে?