কি চিন্তা কোচ্চো এত?
পরাশরবাবু মোজাটা খুলতে খুলতে বললেন, আহা, সে ভারী এক আশ্চর্য চিন্তা। আমাদের মিত্তিরদাকে তো চেনো। তিনি বললেন, তোমাদের ঈশ্বর যদি এত দয়াময়টয় হবেনই, তবে এত অমঙ্গল কেন? এ কথা আমিও ভেবেছি জানো…. উত্তর পাইনি….
মনোরমাদেবী বালিশে ওয়াড় পরাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, সে পুরুষ মানুষের বোঝার কম্মও নয়। আমার এই দুটো শোয়ার ঘর, একটা বারান্দা, একটা রান্নাঘর, ব্যস… এই কি নিজের মনের মত রাখতে পারছি? কতবার বলেছি বাথরুমের মেঝে ওভাবে জলে ভিজিয়ে রাখবে না…. কিন্তু দেখো… যত গোছাই তুমি, তোমার ছেলে, মেয়ে মিলে কি যে ধিঙ্গি নাচ নাচো বাবা…. সব এলোমেলো…. আমার এই দুটো ঘরেই এই অবস্থা… তিনি যে কি করে সামলান…. ও আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি….
পরাশরবাবু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। উত্তর নেই। কিছু বললেই আবার কি শুনতে হবে…. কিন্তু এখন কিছু বলা যাবে না…. শুনে যেতে হবে…
সীতাদেবীকেই দেখো। মন্দোদরীর কপালের দিকে তাকিয়েই আমার তো মনে হয় সবটা মেনে নিয়েছিলেন। নইলে তিনি তো জগদম্বা, ও রাবণকে এক চড় মেরে নিজেই চলে আসতে পারতেন। কিন্তু তাতে মন্দোদরীর ইগো হার্ট হত, তাই না? একজন মহিলার কাছে নিজের স্বামী, সে যেমনই হোক না কেন, অন্য মহিলার কাছে হেনস্থা হতে দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগত না… তাই রামকে দিয়ে মন্দোদরীকে মুক্তি দিলেন। শূর্পনখার তো এমনিতেই কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, ভীষণ ইম্পালসিভ… তায় রাবণ…. রাম মুক্তিই দিলেন…
কিন্তু ওই পাতাল প্রবেশ….
আমার মনে হয় রামকে একটু স্পেস দেওয়ার দরকার ছিল। নইলে সে বেচারা সব নিয়ে নাজেহাল যা হচ্ছিলেন! বউ বুঝবে না তো কে বুঝবে? আর তিনি তো জগদম্বা, ও রামের কাছে তো সব সময়েই আছেন। আমাদের কাছেই যে না পাতাল-টাতাল…. তিনি তো সর্বত্রই…. আসলে আমাদের পার্স্পেক্টিভে না দেখলে বুঝবে না….
যেমন?
রাধাকেই দেখো না। রাতদিন কৃষ্ণকে নিয়ে কি নাজেহাল। এত গোপী। তায় নিজের সংসার। তোমরা যাকে বলো প্রেম, আমি দেখি বিশুদ্ধ অ্যাডজাস্টমেন্ট। অভিসারকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি। আসলে ওগুলো সব অ্যাডজাস্টমেন্ট। পার্বতী আর রাধা, দু'জনেই অ্যাডজাস্টমেন্টের চূড়ান্ত। একে তোমরা যতই গ্লোরিফাই করো না কেন, আমার কাছে বিশুদ্ধ ঝক্কি, বুঝলে। একজনের যখন তখন প্রেমের গুঁতো, আরেকজনের খামখেয়ালি উদাসীপনা… সব মিলিয়ে দু'জন যা সামলেছেন…. কেন বলো তো? ওই এক। দু'জনেই জগদম্বা বলে। এই টেরিফিক অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্ষমতাটা না থাকলে সবটাই ভরাডুবি। সেটা তোমাদের নেই বুঝলে? ওই মিত্তিরদা সংসার করেননি বলে ওসব তত্ত্ব আওড়িয়ে পার পাচ্ছেন… সংসারটা করলে বুঝতেন একটা ঘরকেও সারাদিন ঘর করে রাখতে কি ঝক্কি পোহাতে হয়। তাও তো এ কালের সারদাদেবী, বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা পাড়লাম না। আমরা কেউ-ই যেমনটা চাই, পাই না বুঝলে। তবু এমনভাবে চলি যেন এটাই চেয়েছিলাম। আমাদের ভাবসাব দেখে মনে হবে আঁচড়টাও লাগছে না গায়ে। আর তোমরা এদিক ওদিক একটু সামাল দিতে গিয়ে দস্তা দস্তা দর্শন, তত্ত্ব, নীতি আবিষ্কার করো, বইয়ের উপর বই বাড়াও। বাব্বা, কথাও জানো চাট্টি তোমরা গো! কথার পর কথা সাজিয়ে তিলকে তাল, আর তালকে তিল বানাতে তোমাদের মত ওস্তাদ কেউ নেই। ওইজন্যেই জগতজোড়া দার্শনিক দেখবে সব পুরুষ। জগতের যত সব অবতারেরাও। ওসব খেলা বুঝলে হে। এ জগতের মূল চাবিকাঠিটা অনন্তকাল ধরে আমাদের হাতেই। সাধারণ বুদ্ধিতে, স্বাভাবিক, শুভবোধ। এটুকু বুঝতে তোমাদের কত নক্সা বাপ রে বাপ! মুক্তি, পাপ-পুণ্য… আরো কত কি… উফ্…. যেন গোটা সংসার সাদা-কালোতে ভাগ করে দেখতে চাচ্ছো। রান্নাঘরে এসে দেখো, নুন আর চিনি দুটোই লাগে। ওই দুটোকে হিসাবে না রাখলে রান্না হয় না। তোমাদের হাজার একটা বাড়াবাড়ি কথাতে আমাদের যা হাসি পায়!
কথা আর বাড়তে না দিয়ে পরাশরবাবু বললেন, এত কথা ভাবো কি করে গো? এসব তো কোনো শাস্ত্র-র কথা না…
মনোরামদেবী খাট থেকে নামতে নামতে বললেন, পেট থেকে পড়েই সব শিখে যাই গো…. হাতাকে হাতা, আর গামলাকে গামলা বলতে ওসব পুঁথি পড়তে হয় না…. হাতা আর গামলা একই ধাতুতে তৈরি ইত্যাদি অকাজের গুচ্ছের বাজে কথা ভাবতে বলতেই যত পুঁথি লাগে….
কিন্তু সে তো সত্যি কথা….
মনোরমাদেবী আলোটা অফ্ করে বাইরে যেতে যেতে বললেন, সংসারটা কাজের কথায় চলে গো… ওসব অকাজের সত্যি কথায় না…. আঁখের গুড় আর আঁখের স্বাদ পেতে কেউ আঁখ গাছ চিবায় না…. ঘুমাও….
(ছবি: Suman)