সত্যের আনুগত্য শেখাবেন, না ব্যক্তির আনুগত্য শেখাবেন - এ সিদ্ধান্তটা কিন্তু আপনাকে আপনার সন্তানের ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাবাকে কি মাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই যদি সন্তানের সাত খুন মাফ হয়ে যায়, তবে আপনি যে ওর কি সর্বনাশ করছেন সে এখনই হয় তো স্পষ্ট বুঝতে পারবেন না, না তো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারবে।
আমাদের ভক্তিধর্মের দেশ। বাবা মা ঈশ্বরের আরেক রূপ, ইত্যাদি নানা ধরণের আদর্শকথা শুনতে শুনতে আমরা বড় হই। আর সর্বনাশের বীজও সেইদিন থেকেই বোনা হয়। আমি দেখেছি বাবা মাকে তুষ্ট করে বেড়ে ওঠা সন্তান ধীরে ধীরে কেমন মেরুদণ্ডহীন, জড়পিণ্ডের মত হয়ে যায়। নিজের বিচারবুদ্ধি শক্তি, নিজের বিবেচনা শক্তির কোনো বিকাশ হয়ে ওঠে না। কি বিষাদে, অসুখে জীবনযাপন করতে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে ভীষণ কাছ থেকে দেখেছি। যখন সে বুঝতে পারে যে তার ডানা ছাঁটা হয়েছে জন্মলগ্নেই তখন তার মধ্যে তার মধ্যে বাবা-মাকে নিয়ে বিদ্বেষ তৈরি হয়। সে বুঝতে পারে তাকে তার মত করে সত্যটাকে, ঠিকটাকে বুঝে চলার মত পরিবেশ কোনোদিন দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে যে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, কিভাবে দাঁড়াবে? নিজের ব্যক্তিত্বই তো গড়ে ওঠেনি সঠিকভাবে। সে গুমরে গুমরে মরে। ভিতরে ভিতরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পায় না নিজেকে প্রকাশ করার। যদি বা করতে যায়, সে এমন বিশ্রী বিকারযুক্ত রাগ, অভিমান ইত্যাদিতে প্রকাশ পায় যে সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না, এর পরের ধাপটা কি হবে।
আমাদের দেশ ব্যক্তিপূজার দেশ। গুরু, অবতার, নেতা, কবি, লেখক, নায়ক, গায়ক, অভিনেতা, খেলোয়াড় ইত্যাদি সবাই আমাদের পূজ্য হতে পারে। ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই আমাদের জীবন সার্থক। এ ভাব আমরা জন্মসূত্রে লাভ করে থাকি। নিজের যুক্তি-বিচার বোধকে খুব বিশ্বাস করি না আমরা। নৈর্ব্যক্তিক সত্য না নীতিতে আমাদের আস্থা নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম - আমাদের এই আদর্শ বলেই আমরা জানি যিনি কোনো পদে আসীন, তিনি তার ইচ্ছায় সে পদকে নিজের মত ব্যবহার করতেই পারেন। সেই পদের প্রোটোকল অনুযায়ী তিনি যে বাধ্য হতে পারেন, সে আমাদের ভাবনাতেই আসে না। যদি কেউ প্রোটোকল মেনে চলেন, তবে তিনি ভীষণ ‘অন্যরকম’। তাই আমরা ঘুষে বা বক্তিগত অনুগ্রহে যতটা বিশ্বাস রাখি ততটা কোনো নীতিতে না।
আসলে আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে ‘সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্যং মামেকম শরণম ব্রজ’, অর্থাৎ গীতার যে চূড়ান্ত কথা, সব ধর্ম ত্যাগ করে আমার শরণাগত হও, আমি তোমায় তোমার সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব।
এ ছিল গীতার কথা। এর দার্শনিক ব্যাখ্যা বা ভক্তিতত্ত্বে ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, আমাদের নিত্য সংসারে এ সমস্ত গোলোমালের মূল হতে পারে। পুলিশ, নেতা, পদস্থ অফিসার, ভণ্ড গুরু, ভণ্ড অবতার ইত্যাদিরা যখন বলেন, ‘আহা তোমায় অত সাধ্যসাধনা করতে হবে কেন? তুমি আমায় সন্তুষ্ট করো, আমি তোমার জন্য সব করে দেব।’ তখন সে ভীষণ গোলমেলে কথা হয়ে যায়। ভারতের দর্শনে ও ধর্মে এমন ফাঁকিবাজি বাইপাস করা তত্ত্ব ছাড়া পুরুষকারের কথাও ছিল, যা আমাদের বুদ্ধ শেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের মনে ধরেনি। আমরা বুদ্ধকে অবতার বানিয়ে বুদ্ধকে ভোলাতে চেয়েছি, নিজেকে ঠকাতে চেয়েছি। বুদ্ধ যে ভোলেননি সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই, কিন্তু আমরা যে যুগে যুগে নিজেকে ঠকিয়ে চলেছি সে নিয়েও কোনো সংশয় নেই। এক একজন অবতার জন্মাচ্ছেন, তাকে কেন্দ্র করে, তাকে পুঁজি করে এক একটা সম্প্রদায় তৈরি হচ্ছে, নতুন করে আবার মগজ ধোলাই কল খোলা হচ্ছে। গীতায় যখন কৃষ্ণ বুদ্ধের রাস্তা ধরে বললেন, ‘নিজেকে নিজেই উদ্ধার করো, তুমিই তোমার সব চাইতে বড় শত্রু, আর তুমিই তোমার সবচাইতে বড় বন্ধু’, তখন সে কথা নিয়ে আমাদের সমাজ চলল না। আমাদের সমাজ চলল ওই ফাঁকিবাজীতে, তস্মিন তুষ্টম, জগত তুষ্টম, অর্থাৎ তোমায় তুষ্ট করতে পারলেই জগত তুষ্ট।
সন্তান বাবা মায়ের উপর নির্ভরশীল হবে, এ বাস্তব। কিন্তু তাকে নিজের মেরুদণ্ডে দাঁড় করানোর শিক্ষা দিতে হবে, এ বাবা মায়ের প্রথম কর্তব্য। আমায় খুশী করলেই যদি সে পার পেয়ে যায়, বা অমুক গুরুকে তুষ্ট করলেই যদি সে পার পেয়ে যায়, তবে মানুষ হিসাবে তার একান্ত দুর্গতি। আমার নিজের বিচার চিন্তায় আমার মত করে সত্যকে খুঁজে নেব, সেই অনুযায়ী চলব বলেই নিশ্চয় জগতের মালিক আমায় একটা স্বাধীন বোধ বিচারের শক্তি দিয়েছেন। তাকে প্রতিদিন হাজার একটা লোভ, মোহ, ভয় থেকে বাঁচিয়ে চলব, এই তো আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর সাধনা। সেই চলার জন্য আমার মধ্যে যে আত্মপ্রসাদ জন্মাবে, সেই তো আমার মধ্যে দিব্যবোধের অনুভব। লোভের কাছে, মোহের কাছে, ভয়ের কাছে মাথা নীচু না করলে যে চিত্তপ্রসাদ, যে আত্মশক্তি নিজের মধ্যে জন্মায়, সেই তো ঈশ্বরত্ব। কোনো একজন ব্যক্তিকে তুষ্ট করে চলাই কি আমাদের একমাত্র ভবিতব্য, সে তিনি যেই হোন না কেন?
আমরা আমাদের সন্তানকে আর যেন যেখানে সেখানে মাথা নীচু করতে না শেখাই আমাদের সংস্কৃতির অজুহাতে। সেদিন দশরথের অমন উৎকট বায়না না শুনে রামচন্দ্র যদি দেশে থেকে সুশাসন কায়েম করতেন, সে অনেক বেশি কাজের হত। রাবণ নিজের কুকর্মের ফলে আপনিই নিঃশেষ হয়ে যেত। বা অযোধ্যা থেকে সৈন্য নিয়ে গিয়েও তাকে মারা যেত। কিন্তু এমন অন্যায্য অনুরোধ শুধু বাবা হওয়ার সুবাদে যদি কেউ করতে পারেন, তবে সে খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়। সীতা বা লক্ষ্মণ শুধু নন, রামচন্দ্রের মায়েরও দায় ছিল সত্যটা বলার। যেমন দায় ছিল ধৃতরাষ্ট্রের সভায় ভীষ্মের প্রতিবাদ করার। তিনি করেননি বলেই মহাভারতের শেষে শান্তিপর্বে ওনার কথা অপ্রাসঙ্গিক।
কিন্তু এ তো গেল মহাকাব্যের কথা। এ প্রসঙ্গ এই জন্যেই আনা যে আমাদের সমাজে আদর্শ নির্বাচনে আমরা এখনও এ দুটি মহাকাব্যকেই ধ্রুব মেনে থাকি অনেকেই।
কেউ আমার কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠুন তার চরিত্রের জোরে, কোনো সম্পর্ক, ক্ষমতা, পদ ইত্যাদির জোরে নয়। আমি অনুপ্রাণিত হই লক্ষাধিক মানুষের কাছ থেকে, কিন্তু কাউকে অন্ধের মত অনুসরণ করা মানে নিজের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষতিও ডেকে আনা। ক্রিটিকাল থিংকিং বা জোর করে বাংলা করলে যদি বলি তুল্যমূল্য বিচার বা সার্বিক বিচার করতে ছেলেমেয়েদের শেখান। শ্রদ্ধা করার শক্তি থেকে বিচার করার শক্তিতে মানুষ সত্যকে বেশি করে পায়। শ্রদ্ধাবানই জ্ঞান লাভ করে - গীতার এ কথা হয় তো কোনো মিস্টিক জীবনে প্রযোজ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখা যায় যেখানে যত প্রশ্ন, যেখানে যত সংশয়, সেখানেই জ্ঞানের তোরণ খোলা।
সম্মান আর শ্রদ্ধা কথাটার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সম্মান আমার ও অন্যের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রক্যকে মেনে নেওয়া সদর্থকভাবে। আমার ব্যক্তি হিসাবে অধিকারকে অস্বীকার না করা। কিন্তু শ্রদ্ধা আমার আনুগত্য দাবী করে। সে বলতে চায় আমি তোমার থেকে উন্নত, তাই তুমি আমার অনুগত হও। আমার থেকে উন্নত তুমি হতেই পারো, কিন্তু তার জন্য আমি আমার ব্যক্তিসত্তা তোমার কাছে বন্ধক দিতে যাব কোন দুঃখে?
তাই যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটাই আবার বলি। আপনার সন্তানকে ভুল করার সুযোগ দিন, নিজের বোধবুদ্ধিকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার সুযোগ দিন। আপনি নিজেকে পার্ফেক্ট ভেবে ওর ইম্পার্ফেকশানকে অপমান করবেন না অনুগ্রহ করে। তাকে ক্রমে বড় হতে দিন। সে বুঝুক সত্যিটা আপনাকে কনভিন্স করাতে পারলে আপনি জেদ ধরে তাকেই ভুল প্রমাণ করতে চাইবেন না, বরং আপনি খুশী হবেন। এ বিশ্বাস, এই ইমেজ আপনাকে নিয়ে তার মনে তৈরি হোক যে আপনি আর সে দুজনেই সত্যিটা, বা ঠিকটারই সমর্থক। কেউ কারোর ইগো নিয়ে লড়াই করার জন্য মুখিয়ে নেই। এতেই সে দিনে দিনে স্বাবলম্বী হবে সত্য অর্থে, শুধুমাত্র আর্থিক দিক থেকে নয়। কারণ ওরকম উপার্জনক্ষম মেরুদণ্ডহীনের উদাহরণও কম নেই আমাদের সমাজে। সে কার অনুগত হবে ঠিক করতে না পেরে, একজনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আরেকজনের উপর অনায়াস অবিচার করেই চলে। এবং সে যে অবিচার করছে, এ বোধও তার চিত্তে জন্মায় না, এমনি অসাড় হয়ে যায় সে।
এ না ঘটুক। আত্মশক্তি লাভের চাইতে বড় লাভ সংসারে দুটি নাই।