অন্ধকারে ভূত কল্পনা করে যেমন ভয় হয়,তেমনই এ বিশ্বসংসারের একজন চালক আছে কল্পনা করে ভক্তি হয়।
মজা হল, কল্পনাটা কল্পনাই, কিন্তু অনুভবটা তো বাস্তব। তাই অনুভবটা বাস্তব বলে মানুষ এরপর কল্পনাটাকেও বাস্তব বলে ভ্রমে পড়ে। ফলে ভগবান আর ভূত দুই-ই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
একি ভুল কিছু? আদৌ নয়। কল্পনা আর বিশ্বাস খুব দূরের কথা নয়। আমি যাকে আমার বন্ধু বলে বিশ্বাস করি, তাকে দেখলে আমার অনুকূলভাবের অনুভব হয়। সেই অনুকূলভাবের অনুভবকে আমি ভালোবাসি। কারণ সে আরামদায়ক। স্বস্তিদায়ক। এইবার বাস্তবে কখনও যদি সেই বন্ধুটির সম্বন্ধে জানতে পারি যে সে আসলে আমার বন্ধু ছিল না, তখন আমার অনুভব হয় প্রতিকূল। আমি আমার স্বস্তিদায়ক অনুভব হারিয়ে ফেলি বলে আমার রাগ হয়। নিজেকে ঠকে গেছি বলে বোধ হয়। আরো রাগ হয়।
এরকম নানা বিশ্বাস আর কল্পনাজাত অনুভবে তৈরি আমাদের ঠুনকো জীবন। শঙ্করাচার্যের ভাষায় পদ্মপত্রের জলের মত টলটলায়মান। যে বিশ্বাস আর যে কল্পনা সদর্থক, সে বিশ্বাস ও কল্পনাজাত অনুভবেরাও সদর্থক; যে বিশ্বাস ও কল্পনা নঞর্থক, সে বিশ্বাস ও কল্পনাজাত অনুভবও নঞর্থক। এক-একজন মানুষের জীবনে এই সদর্থক আর নঞর্থক ভাবের এক এক অনুপাত থাকে। সেগুলো অবশ্যই পরিবর্তনশীল। মনের রোগ হলে, মনোবিদেরা এই সাম্যকেই নতুন বিশ্বাস বা নতুন কল্পনায় রাঙিয়ে সদর্থক অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চান। কারণ অনুভবটাই আমাদের অন্তর্জগতে বাস্তবতার পরিচায়ক।
তবে কি আমরা বাস্তবটা বাস্তব হিসাবে জানতে পারি না? না পারি না। আমরা আমাদের কল্পনা আর বিশ্বাসে রাঙিয়েই দেখি। তা যদি না হত তবে আমাদের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য আর কি হত? তারাই আসলে ঘোর বাস্তবে আটকে। আমরাও আটকে, তবু আমাদের কিছুটা পারমুটেশান কম্বিনেশন করার সুযোগ আছে কল্পনা আর বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওদের সে সৌভাগ্য তাদের মস্তিষ্ক হতে দেয়নি।
তবে এই চক্রের হাত থেকে মুক্তি কিভাবে চাই আমরা? আমাদের অনুভবের ঢেউ কমিয়ে তাকে শান্ত করে। শান্তচিত্তে কেউ দুশ্চিন্তা করে না। আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কেউ অন্তরে শান্ত থাকে না। তবে? কোনটা আগে সামলাবো? অনুভব না কল্পনা? অনুভবটা বাইপ্রোডাক্ট। ওটা আমাদের সরাসরি হাতে নেই। আমাদের হাতে আছে কল্পনা আর বিশ্বাস। এই দুইকে নিয়ে আমরা কিছুদূর অবধি নাড়াঘাঁটা করতে পারি। আপনি যেমন ভাববেন, তেমন অনুভব হবে। মনের থেকে বৈরীভাব কমালে মন শান্ত হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য। এই ভাবটা কমানোর জন্যেই এত এত ধর্ম তথা মহাপুরুষের আগমন। কিন্তু আমাদের সে সব শুনতে বয়েই গেছে। কারণ আমাদের বৈরিতার মধ্যে যে অনুভব তাকে ভালোবাসি। বেশ একটা যুদ্ধু হবে মত ভাব থাকলে মনে হয় এই তো বেঁচে আছি। মনে মনে হাজার একটা শত্রুপক্ষ বানিয়ে নিলে যে একটা চিড়বিড়ে অনুভব হয় তাকে আমরা বীরত্ব বলি। পুরুষাকার বলি। শান্ত অনুভবকে ম্যাদামারা বলি। ও আমরা চাইনে। আসলে আমরা চাই আমাদের মধ্যে অশান্তির অনুভব থাকুক। তবেই আমরা নিজেকে জীবিত বোধ করি। লালনের ভাষায় 'জ্যান্তে মরা' হয়ে আমার লাভটা কি? তাই আমরা মুখে যাই বলি না কেন, মনে মনে বেশ টকঝাল স্বাদের ভাবনা এনে, সেই থেকে চুঁইয়ে পড়া অনুভবে বাঁচতেই তো ভালোবাসি। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সেই আঁশচুপড়ির গল্প মনে নেই? সেই যে গো, একজন মাছ বিক্রি করে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। তো এক ফুল বিক্রেতার বাড়ি রাতে আশ্রয় নিল। তো সে মেছুনীর ঘুম কিছুতেই আসে না। অত ফুলের গন্ধে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে যে! তবে উপায়? তখন সে কি করল, সেই আঁশ চুপড়িটা মাথার পাশে রেখে তাতে জল ছিটিয়ে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাতে লাগল।
তো এই তো হল রামকৃষ্ণ ঠাকুরের গল্প। এখন যদি বলো, সেই আদিম প্রশ্নটা আমায় জিজ্ঞাসা করো, তা তোমার বাপু কি মনে হয়, ঈশ্বর আছেন কি নেই?
আমি বলব, আমাদের অন্তরের জগতে বাস্তব বলতে যতটুকু আমাদের অনুভব, যেমন চোখের অনুভবে জগত শোভনে অশোভনে; কানের অনুভবে জগত সুরে অসুরে; জিভের অনুভবে জগত খাদ্যে অখাদ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি; তেমনই চিত্তের অনুভবে জগত মঙ্গলে অমঙ্গলে। জগত বলে আমরা যা বুঝি প্রকারান্তরে সে আমার অনুভব শুধু। আমার স্ত্রী-স্বামী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-দেশ-রাজনীতি ইত্যাদি সবই আমার অনুভবের বাস্তবতায় বাস্তব। নইলে তারা আর পাঁচটা মানুষের মত শুধুই মানুষ। সম্পর্ক সূত্রহীন। তখন উকিল ডেকে ভালোবাসার মানুষকেই দূরে ঠেলার জন্য উঠে পড়ে লাগি। কারণ যে আমার অনুভবের অন্তরের বাস্তবতায় নেই তাকে বাইরের শুষ্ক জানার বাস্তবতায় বয়ে বেড়ানো অসহ্য। এইভাবে নানা মোড়ে আমাদের নানাভাবে ডিভোর্স হয়। এমনকি নিজের সাথেও? কিভাবে? বলছি।
আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে নিয়ে একটা কল্পনা আছে। সেই কল্পনাজাত অনুভবও আছে। এখন সেই কল্পনা যখন কোনো কারণে ভেঙে যায় তখন নিজেকে নিয়ে নিজের অনুভবটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। মানে এতদিন আমার অনুভবে বাস্তবে আমি যা ছিলাম তা হঠাৎ ভেঙে গেল। "আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে"। এমন সময় মানুষ দিশা না পেয়ে আত্মহননের রাস্তাও বেছে নেয়। কারণ নিজের ইমেজ আর সেই ইমেজজাত অনুভব শূন্য হয়ে গেছে বলে তার বাস্তবতাই শূন্যতে এসে ঠেকেছে যেন।
এতো গেল কল্পনা আর বিশ্বাসের কথা আর তার সঙ্গে জন্মানো অনুভবের কথা। কিন্তু তথ্যে যা জানি? সে শুধুই স্মৃতিতে জমা নানা অকামের মণিমাণিক্য। জগত বলতে আমার অনুভবের প্রতিবিম্ব। সে অনুভবে তিনি থাকলে তিনি আছেন, তিনি না থাকলে তিনি নেই। এ তর্কের বিষয় নয়। তাই তর্কে এর সমাধান মেলে না। নিজের পথে নিজের মতে চললেই গোল মিটে যায়।