- আমার কোথাও বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না
- কি জ্বালা, লাগে না তো যাবেন না…
- ওভাবে বলছেন কেন? আপনারা এত জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার অ্যাড দেন, আমি একটাতেও যেতে পারি না, আমার একটা বিবেকবোধ নেই?…
- এতো ভারী মুশকিল হল... আমরা তো আপনাকে জোর করছি না রে বাবা…
- সে আপনারা ভালো মানুষ বলে তেমন করে কিছু বলছেন না... কিন্তু এই যে আমি খবরের কাগজটা খুললেই আপনাদের অ্যাড দেখি...চলুন বেড়িয়ে আসি আন্দামান... চলুন ঘুরে আসি পাহাড়... চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান... আমি ফেসবুক খুললেও তো দেখি... তাই ভাবলাম আজ আপনাদের অফিসে এসে একেবারে সামনাসামনি কথা বলেই যাই... আমার না কোথাও বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না…
- সে তো বুঝলাম মশায়... কিন্তু আমার অনেক কাজ আছে... এবার যে আপনি না উঠলেই নয়…
- আমি জানি এ আপনার অভিমানের কথা... আপনি হয় তো ভাবছেন আমি কিপটে... ঠিক তা নয়... আমার এই আটচল্লিশ বছর বয়সে আমি অনেক উপার্জন করেছি... আপনার বয়েস কত?
- ছাপান্ন…
- তা দেখুন, বয়সে বড় আপনি... এমন অভিমান করলে চলে ভায়ের উপর…
- আপনি তো জ্বালিয়ে খেলেন দেখছি... যাবেন না... যাবেন না... তা বলে সাত সকালে এভাবে অফিসে এসে হুজ্জুতি করার কি মানে?
- আহা, দাদা যে দেখছি বড্ড চটেছেন... আচ্ছা, এই ধরুন আপনি সামনের মাসে কুড়ি তারিখ আন্দামান নিয়ে যাচ্ছেন তো? তারপর সেই মাসেই আবার দার্জিলিং... আবার রাজস্থান... আমার একার পক্ষে এত জায়গায় যাওয়া সম্ভব বলুন?
- কি ঝামেলা... সবকটায় যাবেন কেন? যে কোনো একটায় যেতে পারেন…
- পারি, কিন্তু কেন যাব?
- যাবেন না... কিন্তু দয়া করে আসুন এবার... নইলে কিন্তু এবার আমি থানায় ফোন করব?
- অ্যাঁ! মানে, দিদি এরকম নিয়ম করেছেন নাকি? বেড়াতে না গেলে পুলিশে ধরে?
- আপনি আমায় হ্যারাস করছেন... তাই... আপনি…
- আচ্ছা বুঝেছি... আপনাকে আমি ঠিক এক্সপ্লেন করতে পারছি না, তাই আপনার হ্যারাসমেন্ট মনে হচ্ছে… আসলে আমার তো কালীপুজোয় টুনি লাগাতেও ভালো লাগে না... বুড়িমার চকোলেট বোম ফাটাতেও ভালো লাগে না... এমনকি তারাবাজি জ্বালাতেও ভালো লাগে না... আপনার সঙ্গে কথা হলেই আমি টুনির দোকানে, বাজির দোকানে গিয়েও কথা বলব। হাতজোড় করে বলব, ওরে তোরা কিছু মনে করিস না রে... আমায় ক্ষমা করে দে... আমি তোদের কথা রাখতে পারছি না…
- আপনি পাগল... আপনি হলেন বদ্ধ উন্মাদ…
- বলতে পারেন... আসলে টিভি চালালেই, খবরের কাগজ খুললেই... ফেসবুক খুললেই এত এত অ্যাড...মানে সব আমার ভালোর জন্যেই...আমি জানি... এই যে মেয়েটা আমার টিভির স্ক্রিন জুড়ে স্নানে নেমে গেল, কি একটা সাবান কিনতে বলে, সে তো আমার ভালোর জন্যেই... আমার ত্বক, আমার চুল, আমার অন্তর্বাস, আমার জামাপ্যান্ট, আমার বাড়ির আসবাবপত্র, বাড়ির রং, সিমেন্ট-রড, চা, আটা, দু’চাকা, চারচাকা, মায় কি কন্ডোম পরব, কি স্যানিটারি ন্যাপকিন... না না ওটা অবশ্য আমার লাগে না... তবু.. আমার সব কিছু নিয়ে কত মানুষ ভাবেন বলুন…. আমার মা-ও আমায় নিয়ে এত ভেবেছেন কিনা সন্দেহ দাদা.. আর আমি, শুধু পিছিয়ে পড়ছি... এমনকি আমি কোথায় টাকা রাখলে আমার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে তাও বলে দিচ্ছে ওরা... আমি কি অকৃতজ্ঞ দাদা, কারোর কথা রাখতে পারছি না... আমার মধ্যে এক অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে... তাই ঠিক করলাম আপনার অফিসটা যখন এত কাছে আমার বাড়ির... কেন না আপনাকে দিয়েই শুরু করা যাক......
- আপনার চিকিৎসার দরকার... আপনি সুস্থ নন...।
- ঠিক... চিকিৎসার জন্যেও ওরা বলে... আজ রাতে বুকে ব্যথা বলে কি একটা অ্যাড দেয়... সব ডাক্তারেরা পোজ দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন... আমায় ডাকছেন... ক-ইঞ্চি কেটে যেন আমার বাইপাস করে দেবেন কথা দিচ্ছেন... আমার মনে পড়ছে না... দু ইঞ্চি না চার ইঞ্চি?... যাক গে... কিন্তু আমি তাও যেতে পারছি না... বলুন, আমি কি একটা মানুষ তবে? এত এত মানুষের ভালোবাসা, চিন্তা, উদ্বেগ উপেক্ষা করে দস্তুর মত সুখে আছি, শান্তিতে আছি... আমি কি একটা মানুষ তবে দাদা!
ভদ্রলোক কাঁধে ঝোলা নিয়ে উঠলেন। গান গাইতে গাইতে বেরোচ্ছেন, “মা আমায় আর ঘোরাবি কত, কলুর চোখ বাঁধা বলদের মত”...