Skip to main content
sundarban

তো ট্রেনে তো বেজায় ভিড়। ওদিকে অমিতাভ স্যার গুরুগম্ভীর গলায় বারবার বলে চলেছেন দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখা কি অমনি বললেই রাখা যায় স্যার? চলেছি সুন্দরবন।

    কেন যাচ্ছি? কারণ একটাই, এক বছর হল বেড়ানো হল না। মনে মরচে পড়েছে। বাচ্চাগুলো অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বলি করোনা কি তাদের পৃথিবীটা সত্যিই চার দেওয়ালে বন্দী করে দেবে?

    আবার আমরা আমাদের বামাদাকে ধরলুম, বামাদা মানে আমাদের বামাপদ গাঙ্গুলী মহাশয়। ওনার হিমালয় ট্যুরিজিম, যার কথা হল আমরা ট্যুর করাই না, ভ্রমণ করাই।

    ভোর পাঁচটা সাতচল্লিশে গাড়ি হালিশহর থেকে, ধরতেই হবে, নইলে ওদিকে ক্যানিং লোকাল ফস্কে যাবে। কিন্তু আমার তো এদিকে বুক দুরুদুরু করছে, মনে মনে ভাবছি কাজটা কি ঠিক করছি? মানে এই যে হুস্ করে বেরিয়ে পড়লাম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে, বলি কাজটা হঠকারী সিদ্ধান্ত হল কি? ট্রেন অ্যানাউন্স করে দিল। কুয়াশা ভেদ করে আলো দেখা যাচ্ছে। স্টেশানে লোক বাড়ছে। ট্রেন এসে পড়ল।

    ও বাবা, কি ভিড় কি ভিড়! বেশিরভাগ মানুষের মুখেই মাস্ক। আশেপাশে গাদাগাদি করে লোকজন বসে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। একে করোনার ভয়, দুই এত ভোরে বেরোনো। সঙ্গে চায়ের তৃষ্ণা। কিন্তু চা খাওয়ার পরিণতি কি হতে পারে সে ভেবেও ভয় পাচ্ছি, শিয়ালদায় যা লাইন... বাবা গো! শেষে আমার বাহ্যদশার জন্য কি সবার ক্যানিং লোকাল মিস হবে। লজ্জা লজ্জা... থাক্, তার চেয়ে, চা কেন, জলস্পর্শও করব না, যেখানকার জিনিস সেখানেই থাক। আমায় তাড়া না দিলেই হল।

    শিয়ালদহ সাউথে দৌড় এবার। ক্যানিং লোকাল। চড়ে বসলুম। ফাঁকা ফাঁকা। আহা, মাস্কটা একটু নামালে হয় না? হয়। একটু প্রাণভরে শ্বাস নিলুম। ট্রেন ছাড়ল, মুখে আবার মাস্ক চড়ল।

    এদিকে আসা হয়নি আগে। স্টেশানের নামগুলো মাথার মধ্যে সেট হচ্ছে না। লোকগুলো বদলে বদলে যাচ্ছে, মানে পোশাক আশাক। ক্যানিং-এ পৌঁছালাম। স্টেশানে কত খাবার! আহা আহা... পেট আর জিভ নেচে উঠে বলল, আসুন না দাদা, দাঁড়াই একটু। অভিজ্ঞ মন চারদিকে তাকিয়ে বলল, এ সে সময় নয় রে বাছা, সে ডাক এলে যাবি কোথায়! ধৈর্য ধর পেট, ধৈর্য ধর।

    মা গো মা, একে কি রাস্তা বলে! বলি তোরা মোড়ে মোড়ে অর্থোপেডিক রাখিস না কেন ভাই? কিম্বা অটোচালককে ফার্স্ট এইডের শিক্ষা দিয়েছিস? নাকি রাস্তায় হাড়গোড় দুমড়ে ফেলে রেখে চলে যাবি বাপ আমার!

    সেকি যাত্রা কি বলি! অটো একবার ডানদিকে হেলে রাস্তায় পড়ো পড়ো হয় তো আবার বামদিকে। বলি এমনিতেই আমাদের ডানে বাঁয়ে উভয়সঙ্কট এখন, এর মধ্যে এই পথ। যা হোক, ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গ্রাম শহর হাঁস মুরগী ছাগল গরু দেখতে দেখতে ঘাটে গিয়ে পৌঁছালাম।

    মানেটা কি? একে তো হাড়গোড়ের অবস্থা খারাপ, তার মধ্যে একটা কাঠের লম্বা পাটাতন জুড়ে মাঝি বলে, “এই বেয়ে উঠে এসো, বাঘ দেখতে যাবে না?” দেখব তো। বাঘ জঙ্গল দেখব বলেই তো আসা রে বাবা। কিন্তু এই সরু পাটাতন বেয়ে তা বলে? নীচে নদী। এদিকে পাড়, ওদিকে মান্নাবাবু'র লঞ্চ, রাজদূত। মাঝে সরু পাটাতন।

    যা হোক, যতটা ভয়ের ভেবেছিলাম তা হল না। দু'জন মানুষ দু'দিকে বাঁশ ধরে দাঁড়ালেন। একজন পাড়ে, একজন লঞ্চের উপর। বাঁশটা হল হাতল। ধরে ধরে বেয়ে যাও। এই প্রথম বাঁশকে দেখে এত আশ্বস্ত হলাম। সবার একটা ভালো দিক থাকে, মহাপুরুষেরা পঁই পঁই করে শিখিয়েছে না? আজ হাড়ে হাড়ে প্রাণে প্রাণে অনুভব করলাম। পা বাড়ালাম পাটাতনের দিকে। হাতে বাঁশ। আর কোনোদিন বলব না “বাঁশ দেওয়া”, এটা মোটেও খারাপ কথা নয়, বাঁশেই আমার প্রাণের স্থিরতা এখন। যা হোক, 'জয়গুরু' বলে রাজদূতে পা রাখলুম।

    শুরু হল যাত্রা। জলখাবার এসে গেল। গোগ্রাসে নদী দেখতে দেখতে গিলছি। লঞ্চ বেশ লাগল। টয়লেটের দরজায় দেখি লেখা আছে ‘কুমোট’। কেন লেখা? মানে লঞ্চের মালিক কি সব কিছুর নামকরণ করেন? মানে হযবরল কেস? কে যেন তার ছাতার নামকরণ করত না? মান্নাবাবুও কি তবে টয়লেটের নামকরণ করেছেন? কুমোট? মানে কি? মানে কি কামট? নদীতে থাকা প্রাণী? তা নয়, তা নয়। বসে বসে মাথায় খেলে গেল, ওটা আসলে কমোড। নোনাজলের ধাক্কায় কয়েকটা শব্দ এদিক ওদিক হয়ে গেছে আর কি।

    লঞ্চ চালককে কি বলে? সারেং? তাই বলে হয় তো। কিন্তু আমার ওই শব্দটা অত ভালো লাগছে না, আমি বলি 'মাঝি'। তা মাঝি'র হাতে তো কালের চাকার মত চাকা। সে ঘোরায় আর নদীর নাম বলে। আমি শুনি আর ভুলি। লঞ্চের সামনে ডেকের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে। আমার সহযাত্রীরা আমরা সবাই এক পরিবারের মত। বন্ধুবান্ধব দাদা দিদি কাকু কাকিমা আর কয়েকজন কচিকাঁচা। বেশ হইহট্টোগোল হচ্ছে। কিছু কিছু লঞ্চের উপর ইয়া বড় বড় বক্স বাজিয়ে সেকি নাচ! দেখছি আর গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে, বলি হ্যাঁ রে, এই সব গান তো শহরে শুনে শুনে কান-মাথা ঝালাপালা হয়ে গেছে, তোদের আমির খাঁ-এর বাগেশ্রী চালাতে বলছি না, কি কণিকা'র 'বাজে করুণ সুরে'ও না, একটু শান্ত হয়ে এমন মনোরম শান্তির পরিবেশের আনন্দ কি নেওয়া যায় না? না তা হবে না, যেন ওরকম বিশ্রী ছ্যাড়াব্যাড়া করে হাত-পা ছুঁড়লেই বেজায় আনন্দ হয়, আগেকার দিনের সিনেমার রাজলক্ষ্মীদেবীর মত বলতে ইচ্ছা করছিল, মর মর মিনসেগুলো...

    লঞ্চ ভিড়ল গোসাবায়। আবার পাটাতন। আবার নীচে নদী একদিকে বাঁশ। নামুন। নামছি। মনকে বলছি এই তো আর কয় পা, তারপরেই ডাঙা।

    এই তো ডাঙা। হাঁটছি। গরম লাগছে। সামনে হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। এ সব কথা পড়েছি। সমবায় পদ্ধতি দেখে উনি খুব খুশী হয়েছিলেন, ফলকে বড় বড় করে লেখা। চারদিকে সবাই ছবি তুলছে। নিজেদের ছবি। রবীন্দ্রনাথের মাথা ঝোঁকানো বড় একটা স্ট্যাচু। হাতে মনে হল বই ধরা। অমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন কিনা জানি না, তবে শুয়ে বসে পড়তেন বিস্তর ছবি দেখেছি। তবে যদি বলেন আমার গোসাবায় কি সব চাইতে ভালো লেগেছে, আমি বলব গোসাবা থানা। আহা, কি সুন্দর বাগান গো বাইরে! কত বাহারি ফুল। কি ভালো যে লাগল। সবাই যখন এদিক ওদিক ঘুরছে আমি তখন থানার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলের গাছ দেখলাম। থানা আর বাগান --- শব্দদুটোকে মন একসাথে এমন সুন্দর করে আলিঙ্গন করে নিল, কি আর বলি।

    যা হোক, আবার লঞ্চ ছাড়ল। এদিক সেদিক মাঝে তৃষিত নয়ন। এমনই সে তৃষ্ণা যে তীরে চরা বাছুর দেখে হরিণ বলে বোধ হয়; পাড়ে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি দেখে কুমীর বোধ হয়; নদীর ধারে নরম মাটিতে যত গর্ত সব বাঘের পায়ের থাবাচিহ্ন বলে বোধ হয়; যত জঙ্গল দেখলেই মনে হয় প্রতিটা গাছের পিছনে একটা করে বাঘ দাঁড়িয়ে। ইচ্ছা করে সামনে আসছে না। স্রেফ ইচ্ছা করে।

    লঞ্চ ধীরগতিতে এগোচ্ছে। নদী মানে এতদিন জানতাম সোজা একটা জলের ধারা। তার যে এত মোড় তা কি আর আগে চোখে দেখেছি নাকি! তে-মাথার মোড়, পাঁচমাথার মোড়। নদী তো না, যেন বড় রাস্তা আর গলি।

    ওদিকে লঞ্চে এলাহি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। আমি একটুও ভোজনরসিক নই। তাই সে সব পদের বিস্তারে আর গেলাম না। মাছ খাই না, তাই সে সব নানা নামের চক্করেও আর গেলাম না।

    রাজদূত চলছে। বামাদা ট্যুরের আগেই বারবার সাবধানবাণী শুনিয়েছেন, কিছুতেই যেন এখানকার জল মুখে না দিই, দিলেই বেজায় পেট খারাপের সম্ভাবনা। আবার আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত। আমি পেটরোগা মানুষ। এইসব ভয় দেখানো কেন বাপু? শুনেই আমার ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র সুপ্রিয়াদেবীর মত বলতে ইচ্ছা করল, বামাদা আমি কিন্তু সুন্দরবন দেখতে চেয়েছিলাম... দাদা আমি সুন্দরবন দেখব... দেখব... দেখব…। বামাদা আশ্বস্ত করে বললেন, যদি ওই ড্রামের জলে, মানে কুড়ি লিটার শোধিত জলে মুখ ধুই তবে ওসবের কোন সম্ভাবনা নেই। সেই ভালো, আমিও নুন-চিনি-জল খেতে খেতে শুয়ে শুয়ে সুন্দরবন দেখতে নারাজ।

    সন্ধ্যের মুখে চলে এল পাখিরালয়, আমাদের রাত্রিনিবাস। চড়াই উতরাই রাস্তা দিয়ে পাকা রাস্তায় অল্প হেঁটেই পৌঁছালাম হোটেলে। বেশ ছিমছাম হোটেল। চারদিকে আলো দিয়ে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। রুম পছন্দ হল। বাইরে ছাতা খাটিয়ে খাওয়া-দাওয়া। তার আগে আমরা দেখব একটা ছোট্টো নাটিকা, বনবিবি উপাখ্যান। কি করে দুঃখীকে বনবিবি আর তার ভাই জংলী দক্ষিণরায়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিল। আমার বেশ লাগল। এত অল্প আয়োজনে এত ভালো অভিনয়, গান, সবটা মিলিয়ে খুব ভালো।

    শরীর বেজায় ক্লান্ত, অগত্যা ঘন গভীর ঘুম চাই একটা। মাঝরাত। প্রকৃতির ডাক, উঠতে হবে। উঠলাম। রুমে আলো জ্বাললাম। সঙ্গেই সঙ্গেই চোখ পড়ল ছাদে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশিরানি। যা ভাবছি তাই কি? তাই তাই তাই...। ...এত 'সুখ' আছে জগতে তোমার বঞ্চিলি শুধু মোরে, বলিহারি বিধি বলিহারি যাই তোরে... ছাদের উপর আটটা পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বেশ পেটমোটা মাকড়সা। আমি অ্যানাকণ্ডা, বাঘ, মায় স্কন্ধকাটা নিয়ে একঘরে থাকতে রাজি, কিন্তু এই প্রাণীটির সঙ্গে সহবাস! অসম্ভব! ঘুম এক ধাক্কায় উড়ে গেল। চেয়ারে বসে বসে ভাবছি কি করা যায়? পাশে শুয়ে আমার প্রাক্তন ছাত্র গভীর ঘুমে। কি করি? দরজা খুলে বাইরে এলাম। বাইরে বসে কাটিয়ে দেব? ধুর... তাও কি হয়? পাশের রুমে টোকা দিলাম। বন্ধু উদ্বিগ্ন মুখে বেরিয়ে বলল, কি হল? বললাম, মাকড়সা। বাকি আর কিছু বলতে হল না। আমরা ঘর পরিবর্তন করলাম। নতুন ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম, বিশেষ করে এসির পিছনের দিকটা। না কিছু নেই।

    সকাল হতেই সবাই জেনে গেল। হোটেলের রক্ষক হাসিমুখে এসে বললেন, আপনি বললেই আমি এসে তাড়িয়ে দিতাম, চারদিকে জঙ্গল তো!

    মনে মনে ভাবলাম, সেই, কথায় যুক্তি আছে। তাই বলে একটা বুড়ো মানুষ যদি মাঝরাতে এসে বলে, দাদা, দাদা, আমার ঘরের ছাদে একটা মাকড়সা জুলজুল করে তাকিয়ে আছে, ওটাকে একটু মেরে দিন, আমি ঘুমাই। বলি আমার একটা পৌরুষ আছে কি নেই!

    সকাল সাড়ে সাতটায় লঞ্চ ছাড়ল। শুরু হল আজ সারাদিন ঘোরা। বাঁকের পর বাঁক; নদীর পর নদী; তীরে শুয়ে থাকা কুমীর; জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণ; জলে ভেসে যাওয়া জেলিফিস; গাছে দোল খাওয়া হনুমান; ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে হরিণের জল খাওয়া --- এ সব নানা কিছু দেখতে দেখতে, নামতে উঠতে দুপুর গড়িয়ে গেল। মানুষ আসলে কতটা শিক্ষিত হয়েছে তা যেমন শহরে এলে বোঝা যায়, তেমন মানুষ কতটা অসভ্য হয়েছে জঙ্গলে গেলে বোঝা যায়। কি চীৎকার, কি চীৎকার! কেউ কেউ আবার ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে হরিণশিশুর বাঘের পেটে যাওয়া দৃশ্য দেখার আশায় মা কালীকে জোড়াপাঁঠা মানত করে ফেলল। বলি হ্যাঁ রে, তোরা কি আজ থেকে একশো বছর আগের মানুষ, যখন টিভিতে এসব দেখাতো না। এখন তো ইউটিউবেই আফ্রিকার জঙ্গলের লাইভ দেখায়। তা আজকের জীবনে স্ক্রিনলাইফ আর রিয়েল লাইফের পার্থক্য কতটুকু বাপ আমার! সারাদিন তো নেটফ্লিক্স, ফেসবুক, হোয়াটস্ অ্যাপেই চিত্তের নিবাস। বাকি যেটুকু জীবনযাত্রা সচল রাখার জন্য দরকার সেইটুকুর জন্য বহির্জগতে ফেরা। তাও এত সাধ!

    দুপুরের খাওয়ার সময় হল। ভাত সবে দু'দলা গিলেছি কি গিলিনি, হঠাৎ মাঝি বলল, বাঁদিকে তাকান। তাকালাম। ও বাবা! ওকি! বাঁদিকে কিস্যু নাই, সাদা আলোর পর্দা। ওটা কি বলুন তো? মোহনা। মানে সমুদ্দুর। চারদিকে তাকিয়ে দেখি থইথই জল আর জল। মাঝি রসিক, বলল, যাবেন ওদিকে? পাগল!!! জানেন না আমরা বাঙালী? আমরা ঘুরি ঠিক, কিন্তু সে আমাদের সেফ জোনের মধ্যে থেকে। যদিও আমরা সারা ভারত মায় পৃথিবীর নানা জায়গায় চক্কর দিয়ে ফেলেছি, তবু আমাদের আলোচনায় খাওয়া, বিছানার সুখ, পরিষ্কার বাথরুম, পেটের নানা ব্যাধির গল্প কেমন ঘুরেফিরে আসে দেখেন না? আমরা সুখী ঘুরিয়ে। অতশত ঝক্কি পোশায় না বাপু। শীগগিরি কোথায় যেন বাঁধা বাঘ আছে সেথায় নিয়ে চলো বাপু। দরকার নেই আমার মোহনায় গিয়ে। যেদিন সময় হবে সেদিন ও মোহনার দরজা কে ঠেকাবে রে বাপু! তা বলে এখন? কেন? আমি কি সাঁতার জানি নাকি!

    ঝড়খালি। চিকিৎসার জন্য পশুদের এখানে রাখা হয় নাকি। তো বাঘ দেখতে না পারা হতাশ পর্যটকেরাও খুশি। দুই বাঘ পায়চারী করছে। কুমীর হাঁ করে বিকালের রোদ লাগাচ্ছে। এই সব দেখে এবার ফেরার পালা আবার পাখিরালয়ে।

    লঞ্চ যেতে যেতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লঞ্চের একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ। দূরে দূরে জঙ্গলের কালো রূপরেখা। অদ্ভুত লাগতে শুরু করল। যেন সমস্ত জানা জগত থেকে বাইরে এসে দাঁড়ানোর ডাক এসেছে। একা একা ভেসে যাওয়ার সুখ, ভয়, আশঙ্কা সব একসঙ্গে। এই সময় নিজের জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়। জলের উপর চাঁদের ছায়া ভেসে ভেসে সঙ্গ নিল একটু পর। অল্প অল্প চাঁদের আলো। জীবন তো এমনই না, অল্প একটু আলো, বাকিটা শুধু অন্ধকার। রহস্যময় অন্ধকার।   

    হোটেলে আজ ঝুমুরের আয়োজন। আমাদের সঙ্গী অনেক বাচ্চারা, মেয়েরা নাচতে শুরু করল। বারবার আমাদের ডাক পড়ে, মানে আমাদের পুরুষদের। আমরা আর লজ্জায় এগোতে পারি না। শেষে অনেক পীড়াপীড়িতে কিছু ছাত্র আমার গোল হয়ে এমন নাচ শুরু করল, আমার মনে পড়ল বাল্মীকি প্রতিভা'র সেই নাচ, কালী কালী বলো রে আজ... এর পা ওরা হাঁটুতে, তার পা এর কোমরে, রীতিমতো কুম্ফু নাচ বলা যায়। ওদিকে বামাদা বারবার বলছেন ওদের নৌকা আর পাওয়া যাবে না হয় তো, তোমরা তাড়াতাড়ি ফেরো, কিন্তু তাদের গান একটার পর একটা চলেই যাচ্ছে। সঙ্গে আমাদের দলের বাচ্চারা আর মেয়েরা। সবাই দারুণ খুশী...

    এবার ঘরে ফেরার পালা। সোনাখালি ঘাটের দিকে এগোনো। মাঝে অল্প সময় তীরে লঞ্চ ভিড়িয়ে একটা গ্রাম ঘুরে আসা। আসলে বামাদার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার একটা সুবিধা আছে। মানুষটা পথপাগল। পথের নেশায় মত্ত। বাংলার গ্রামীণ শিল্প, গান, বাজনার উপর কি এক অসীম টান, ভালোবাসা। তাদের সঙ্গে নাচা, তাদের সঙ্গে গল্প করা, তাদের মতো হয়ে যাওয়া, এ এক অন্য অনুভূতি। শাসনে, ভালোবাসায়, স্পষ্ট কথায়, গল্পে, তীক্ষ্ম সুবিধা-অসুবিধার প্রতি নজরে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেন যে মনে হয় আবার এই মানুষটার সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যায়, যে মানুষটা পৃথিবীর এত এত দেশ ঘুরে আসার পরেও আম্ফানের পর ত্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সুন্দরবনের জন্য, যে মানুষটা গ্রামের বিস্মৃতপ্রায় সংস্কৃতিকে শহুরে মনের সামনে সগর্বে স-আবেগে উপস্থাপিত করতে ক্লান্ত হন না। তাই বামাদার পথের নেশার ঘোর পেয়ে বসে অল্প সময়েই, ঘরে ফেরার পথের মধ্যেই বাজে আবার পথের ফেরার সুর, শুধু সময়ের অপেক্ষা।

su2

su3

su4

su5

su6

su7

su8

su9

su10

su11

su12

su13

su14

su15

su16


(ছবিগুলো অমিয় বিশ্বাস Aniruddha Karmakar Surajit Kar Suman Das এর তোলা। বেশিরভাগই সুরজিতের ছবি নিয়েছি)

 

Category