একদিন বিবেকানন্দ বলেছিলেন, খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, আমাদের ধর্ম নাকি হেঁশেলে ঢুকেছে। সেই হেঁশেল থেকে বার করে চরিত্র গঠনের উপর জোর দিতে চেয়েছিলেন মানুষটা।
কিন্তু যা শুনছি, পড়ছি, দেখছি চারদিকে, সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো আবার নতুন করে হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা পড়তে হবে দেখছি। বলি হ্যাঁ গা, আমিষ খেলেই হিঁদুর সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগে এমন কথা তো শুনিনি বাপু। আমাদের বাড়িতে তো পুজোর দিনেও মাছ হয় দেখেছি। তবে কি আমার বাপ ঠাকুর্দা হিন্দু ছিলেন না? আমি শুনেছি দুষ্টমতি হিটলার মশায় নাকি নিরামিষাশী ছিলেন। এবং নাকি অ্যানিমাল রাইট নিয়ে কথাও বলেছেন। মাগো মা! কালে কালে আরো কত কী শুনব, দেখব বাবা!
তবে কি সত্যিই আমাদের ধর্ম হেঁশেল থেকে বেরুবার পথ পাচ্ছে না? আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। একজনের এক বিধবা পিসি ছিল। অনেক ছোটো বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তো সেই পিসির ভাইঝি ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে যেদিন প্রথম মাইনেটা তুলে আনল, সেদিন পিসিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেল। ভাইঝি খুব আদর করে জিজ্ঞাসা করল, কী খাবে পিসি?
পিসি অপরাধীর মত মুখ করে বলেছিল, মুরগীর মাংস খাওয়াবি?
ভাইঝির চোখে জল এসেছিল। কোনো মানুষকে তার স্বাদ অনুযায়ী খেতে না দেওয়াও তাকে এক রকমের অভুক্ত রাখা। তার মানে এ মানুষটা এত এত বছর ধরে অভুক্ত ছিল? তাদের বাড়িতে যখন মাছ, মাংস হয়েছে, এবং যে পিসি নিজেকে দূরে রেখেছে, সে নিজেকে এতটা বঞ্চিতও রেখেছে?
আমি আগেও লিখেছি, আজও লিখছি আবার, মানুষ নিজের রুচি অনুযায়ী খাবে, কিন্তু সে খাবারের নিরিখে 'আমি শুদ্ধ' আর আর 'সে অশুদ্ধ' এই মাপকাঠি যদিতে খায় তবে সে শুধু অন্যের উপর অবিচার করছে না, নিজের উপরেও করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ খাবারের বিচার সম্বন্ধে বলেছেন, যদি হবিষ্যান্ন খেয়েও ঈশ্বরে মতি না হয়, তবে ধিক। আর যদি শূকরের মাংস খেয়েও ঈশ্বরের মতি থাকে সে ধন্য। এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কোন ধর্মের কথা বলছেন? বলছেন আত্মোন্নতির ধর্মের কথা, যা পাকতন্ত্রের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে চিত্ততন্ত্রের উপর। তবে কি হিন্দুধর্মের কোনো সম্প্রদায়ে এই নিরামিষের বিধান নেই? আছে। কিন্তু সেটা কয়েকটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে। কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র পরিচয় নয়। যদি সেই নিরামিষাশী সম্প্রদায়ের মানুষ আমিষাশীদের উপর ঘৃণার মনোভাব রাখে, বুঝতে হবে সে গোঁড়ামির শিকার, কোনো ধর্মেরই সাধক নয়। ঘৃণা আর অভিমান মনের কোণায় লেশমাত্র থাকলে আর যাই হোক নিজের মুক্তির রাস্তার পথ বন্ধ হয়ে যায়। সে নিরামিষ কেন, বাতাস খেয়ে থাকলেও তার মুক্তির রাস্তা বন্ধ। তবে আর নিজেকে হিন্দু বলবে কোন সিদ্ধান্তে?
বিবেকানন্দ ধর্মকে হেঁশেল থেকে বার করে সবল চিত্তের উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। যে চিত্ত বৈচিত্র্যকে সাগ্রহে গ্রহণ করে, তাকে দুরমুশ করে একভূমিতে এনে কপট ঐক্যের নিশান ওড়ায় না, বরং বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করে সাম্যের গান গায়।