১
২৮শে অক্টোবর, ২০১৮; রাত ৯.৩৬
পুরীর সমুদ্র প্রথম দেখে বুকের ভিতরটা 'ধক্' করে উঠেছিল। আজ বহুদিন পর সেই স্মৃতিটা উসকে উঠল তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি এই মুহূর্তে তাজমহলের সামনেই বসে। নীল সমুদ্রে একটা সাদা পালকের মত ভেসে আছে। মানুষের নিজের সৃষ্টির যে কয়েকটা গর্ব আছে অবশ্যই তার মধ্যে এক অতুলনীয় সৃষ্টি। যার অনুপ্রেরণা ভালোবাসা। দৈবী, অধ্যাত্মিক, ঈশ্বরীয় নয় - মানবী ভালোবাসা। গল্পটা আমি জানি, গাইড জানে, গুগুল জানে, মানে আমরা সবাই কম বেশি জানি।
আমার মুগ্ধতার ঘোর কাটল, একজনের বকুনিতে। কে বকছে? পুলিশ। কাকে বকছে? দু'জন বাঙালি মহিলাকে। 'খুব ভালো অবস্থা নয়' এমন দু'জন মহিলাকে। কেন? তারা আমলকি'র মত কিছু ফল কুড়োচ্ছিল তাজমহল সংলগ্ন বাগানের থেকে। একজন অভিমানের সুরে বলল, যেগুলো পড়ে আছে সেগুলোই তো কুড়াচ্ছি বাপু!
পুলিশ কেন শুনবে? আর শুনলেই বা বুঝবে কি করে? দিল লাঠির তাড়া। বয়স্কা মহিলা প্রায় ছুটতে ছুটতে কম বয়েসী মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ক'টা পেলিরে? সে জোরে দম নিতে নিতে বলল, দশ-বারোটা... পরে গুনো দিদি বাস ছেড়ে দেবে, বকা দেবে ওরা আবার।
তাজমহলকে পিছনে রেখে দৌড়াচ্ছে দু'জন মানুষ, মনের মধ্যে তাজমহলের অপার্থিব সৌন্দর্য-সমাধি নয়, মনের মধ্যে আমলকির স্বাদ, কষটা।
আমি তাজমহলের খুব কাছে গেলাম না। কিছু কিছু জিনিসের খুব কাছে যেতে নেই, নিজের ক্ষুদ্র ছায়া তাকেও ছোটো করে দিতে পারে, এমন ভয় হয়। নিখুঁত কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সমঝদার আমি নই, পুরো বাকরুদ্ধ করা সৃষ্টিটার সামনে স্থির বসে আছি। শয়ে শয়ে মানুষের ঢল। বাঙালি, পাঞ্জাবি, তামিল, ওড়িয়া... ফ্রান্স, জার্মান, রাশিয়া, আফ্রিকা, ইরানি... সারা পৃথিবী হাঁটা পথের পাশে যেন বসে আছি। কতরকম ভাষা, কতরকম পোশাক, কতরকম আদব-কায়দা। তার চাইতেও আজব কথা, সমাজের সব স্তরের মানুষের ঢল। জনসমুদ্র।
আমার পাশেই বসে তিরিশ-চল্লিশ জন রাজস্থানি মহিলা। তাদের মধ্যে বয়স্কা আর মধ্যবয়স্কাই বেশি। তারা গল্প করছে তাদের গ্রামের, সাহেবদের গ্রামের, কি করে ওরা সারাদিন পাউরুটি খেয়ে থাকে, বিয়েতে কত বড় দাওয়াত হয়, তাদের শাড়ি পরলে কেমন লাগবে। হঠাৎই একজন ফরাসী বয়স্কা মহিলা তাদের মাঝে বসে তার স্বামীকে ছবি তুলে দিতে বললেন। ভাষার ব্যবধান, দেশের ব্যবধান, অর্থনৈতিক ব্যবধান এক হাসিতেই উড়ে গেল। কত রকম পোজে ছবি তোলার পর একজন রাজস্থানি মহিলা বললেন, তুমহারে গাঁও মেঁ হামে ভি লে জানা... তারা হেসে চলে গেল। এরা হেসে বলল, ওদের নাতি-নাতনিদের দেখাবে আমাদের... হেসেই লুটিয়ে পড়ল সব।
ভিড় বাড়ছে। আশ্চর্য কথা কেউ তাকিয়ে দেখে না, সবাই সেল্ফিতে ব্যস্ত। কত ছবি, কত ছবি, কত ছবি। কেউ চুমু খাচ্ছে, কেউ হাত উঁচু করে তাজমহলের চূড়ো ধরার সেই বস্তাপচা পোজ দিচ্ছে, কেউ জড়িয়ে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ হেসে, কেউ গম্ভীর হয়ে। আচ্ছা, এই যে প্রকাশ্যে চুমু খাচ্ছে, জড়িয়ে ছবি তুলছে, কেউ তো কিছু বলছে না। এত শয়ে শয়ে বাঙালি তো ঘুরছে, কেউ তো পেটাতে যাচ্ছে না, ভ্রুক্ষেপ করছে না, তবে কি বাঙালি মেট্রোতে চুমু খেলেই আপত্তি করে, নাকি অন্যগল্প আছে।
"এটা কার বাড়ি জানেন?"
তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্কা বিধবা মহিলা, আমার দিকে কড়া পাওয়ারের চশমার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, মুসলমানেদের। আকবর বানিয়েছে, জানেন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। বললাম, আপনি যাবেন না কাছ দেখে দেখতে?
উনি হেসে বললেন, না, বুকে কষ্ট হয় বেশি হাঁটতে। মেয়ে জামাই গেছে, নাতিটাও। ওরা আসবে এখনই। তারপর উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাজমহলের দিকে, অন্যমনস্ক হয়ে মানুষ দেখতে লাগলেন। কাউকে মনে পড়েছে কি? যে তাজমহল বানাতে পারেনি, অথবা এমন একটা তাজমহল তার রান্নাঘর, তুলসীমঞ্চ, ঠাকুরঘর আর বিয়ের খাট-আলমারি নিয়ে বানিয়ে দিয়ে গেছে, যার মূল্য শুধু সেই বোঝে? জানি না।
(ছবি কিছু দিলাম না। ইচ্ছা করল না।)
২
২৯শে অক্টোবর ২০১৮; বিকেল ৫.২৭
পৃথিবীতে সব চাইতে তৃপ্তির যে কয়েকটা দৃশ্য দেখেছি তার মধ্যে মধুরতম হয়ত - সন্তান তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে, মা তাকিয়ে দেখছে।
আরেকটা ছবি, যন্ত্রণার - পরিণত সন্তান (ত্রুটিমুক্ত নয়, মায়ের মতই), মাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে, মা নিরুত্তর শুনে যাচ্ছে।
আমি রাজঘাটে এসে দাঁড়ালে মায়ের সেই দুটো মুখ মনে পড়ে। দ্বিতীয়টা বেশি। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি। সব চাইতে গভীরতম অনুভূতিগুলো শব্দহীন, সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের মত।
(এই প্রথম আমার সর্বান্তঃকরণে সেল্ফি তোলার ইচ্ছা হল, উনিও হেসে পোজ দিলেন।)
৩
৩০শে অক্টোবর ২০১৮, সকাল ৭.১৮
ভোরের সূর্য কাজের শিকলের টানাপোড়েনে প্রতিদিন দেখা গেলেও, ঠিকমত তার ডাকে সাড়া দেওয়া হয় না। আমি আর আমার কাজের বাইরে যে একটা মস্ত বড় জগৎ আছে, তা প্রতিদিন মনে রাখার চেষ্টা করাটা সাধনা। আর সেই জগতটায় একবার সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসার নাম - তীর্থ। আমি হরিদ্বারের পথে। সে অর্থে তীর্থযাত্রী নই যে অর্থে মানুষের বানানো দেবতার দরজায় মুক্তি, সিদ্ধির আশায় পড়ে থাকতে হবে। আমি নিজেকে নিজের বাইরে আনার পথে।
একটা ছোট্টো স্টেশানের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। যাকে কাজের জগতে অনাবশ্যক স্টেশান বলে তেমনই একটা স্টেশান। পুণ্যলোভী তীর্থযাত্রীদের ভুরু কুঁচকালো, কারণ ট্রেন 'লেট' করছে। ছুটির মধ্যেও যদি সময়ের তাড়া থাকে তখন বুঝতে হয় সে তাড়াটা বাইরের কোথাও নেই। তাড়া খাওয়াটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাড়া দেওয়ার লোক না থাকলেও 'জুজুবুড়ি'র মত একজন ছড়িওয়ালা আমরা বানিয়েই নিই। নিজেকে নিজের ভ্রমে দৌড় করিয়ে, ব্যস্ত রেখে আত্মগর্বে মত্ত হয়ে উঠি। ব্যস্ততা আর কাজ - এই দুইয়ের বাইরে গিয়ে, অমন নামগোত্রহীন, কুলমানহীন একচালা স্টেশানে পড়ে থাকতে কোথায় একটা বাজে যে!
ট্রেন ছাড়ল, আমার মন আটকে রইল ভোরের সেই অনামী স্টেশানে। সেই নাম না জানা পাখির ডাক, কুয়াশা, দূরে কয়েকটা কুঁড়ে ঘর, সব জড়িয়ে ভোরের সূর্যের দিকে মন তাকিয়ে রইল। ধ্যানের গভীরে ডুব দিল। এ ধ্যান রূপের না। রূপের বাইরে যাওয়ার। মাধুর্যে ডোবার। যে মাধুর্য বাইরে কোথাও নেই, আমারই মনের হেলায় পড়ে থাকা উঠানে আছে। সেখানে বাগান নেই, ফুল নেই, ভোরের পাখি নেই, আছে শুধু কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো আমার নামের সাক্ষর নিয়ে, আমার অহং এর একান্ত সম্বল।
আজ এই ভোরের স্টেশানে মন ঝাঁটা হাতে সেই উঠোনে এসে দাঁড়ালো। আগে কাগজের টুকরোগুলো সরাই। ভোরের পাখি আসুক না আসুক, কয়েকটা গাছ লাগানোর প্রস্তুতি নিই। চিন্তার বস্তু না, ধ্যানের বস্তু খুঁজি। মানুষ তার গভীরতম সত্যকে ধ্যানে জেনেছে, চোখ বন্ধ করে না, নিজের বাইরে নিজেকে নিয়ে তন্ময় হয়ে। এমনই ভোরের নির্জন স্টেশানে অসঙ্গ হয়ে।
৪
৩০শে অক্টোবর ২০১৮; দুপুর ১.৩৪
পকেট সামলিয়ে ভক্তি। হরিদ্বারের মনসা পাহাড়। রোপওয়ে চড়ে ওঠো। ভক্ত-শোষকদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে লাইন দাও। তুমি অপেক্ষা করছ বিগ্রহ দর্শনে মনের কামনা পূরণ করতে, পূজারী অপেক্ষা করছে তোমার প্রসন্ন দানের। "হাসেন অন্তর্যামী"।
৫
৩০শে অক্টোবর ২০১৮; সন্ধ্যে ৬.১৮
হরিদ্বারের গঙ্গারতি। গদগদ ভক্তি। চূড়ান্ত উত্তেজনা। মানুষের ঢল। গঙ্গার মহিমা গানে ভক্তি বিহ্বল ভক্তগণ।
অথচ কদিন আগেই কে যেন একজন গঙ্গা দূষণ রোধে, শুদ্ধিকরণের দাবীতে প্রাণত্যাগ করলেন, অনশনে। আরো কয়েকজন সেই একই ব্রতে, একই পথে। নিরুদ্বেগ ভক্তরা তখন, নীরব সাক্ষী, ভ্রুক্ষেপও নেই। সত্যিই দাদারা দিদিরা... কি বিচিত্র এ দ্যাশ... সবই অ্যাড্রিনালিনের খেলা বুইলেন কিনা...
৬
৩০শে অক্টোবর ২০১৮; রাত ৯.৫১
লঙ্গরখানা, রাস্তার উপর। "ভিখারিদের খাওয়াবেন বাবু?"...কানে বাজল। দাঁড়ালাম, চারিদিকে এত..ভিখারি..এই শব্দটা উচ্চারণ করতে বাধে, কিন্তু প্রতিশব্দ কই? সবাই বসে খাচ্ছে, ট্রে-টা খাবার শেষে এমন চকচকে হয়ে যাচ্ছে, যেন কেউ মাজল। আধপেটা খাওয়া মাজল, কাল খেতে না পাওয়ার আশঙ্কা মাজল। চোখে টাটালো, বুকে টাটালো।
"সাধুকে দুটো রুটি খাওয়াবেন"?
একজন গেরুয়াধারী। তার আগে ঘিরে ছিল বেশ কিছু মানুষ। ডাস্টবিন আর ভাতের থালায় পার্থক্য কম, এমন মানুষ। এত পাই কই? আমার ভাঁড়ারও কি এত?
তুমি সাধু হলে কেন?
(হাসি)
কি বুঝেছ জীবনটা?
বোঝার কি শেষ আছে বাবু, জীবনটা তো কিতাব নয়, যে দশের পর এগারো পাতা, এগারোর পর বারো.. তেরো..
জীবনে দশের পর দুই নম্বর পাতাও চলে আসে, নিরানব্বইয়ের পর বাহাত্তর। কেউ আগেরটা পরে বোঝে, কেউ পরেরটা আগে। যে বোঝায় সে-ই জানে - কখন কাকে কতটা কি বুঝাতে হবে, তুমি শুধু পাতা উল্টিয়ে যাও বাবু, মালিক যে পাতা সামনে আনে সে পাতাটাই বুঝো...
৭
৩১শে অক্টোবর ২০১৮; রাত ৯.৪২
ঋষিকেশ, ধর্মস্থান। ভুলে যান, যোগাস্থান, ভুল উচ্চারণ করলাম, ইয়োগা হাব। জোয়ান জোয়ান রোগা, মোটা, বেঁটে, লম্বা সাদা চামড়া ছ্যামড়া-ছেমড়ি, কেউ খালি পায়ে, কেউ দিদির মত হাওয়াই চটিতে, খুউউউব সাধারণ বেশভূষা, যা অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়, শখের দারিদ্র্য। শৌখিন ত্যাগ। ঈশ্বর ব্রাত্য, ঈশ্বরের গায়ের গন্ধের ব্যবসা - বহুমূল্য শান্তির কসরত। গলিতে গলিতে গুরুর বিজ্ঞাপন। যোগের বিজ্ঞাপন।
ধাক্কা লাগল চলতে ফিরতে। কি প্রহসন! গঙ্গার পাড়ে গু, মেম প্রফুল্ল হয়ে বলে উঠল, গিফট ফ্রম গড! তার সাহেব কত্তা বলল, সো বিউটিফুল।
উচ্ছৃঙ্খলতা আছে, যথেচ্ছাচার আছে, 'নেটিভদের' প্রতি কৌতুহল আছে, উন্নাসিকতাকে ঢেকে রাখা ধর্মীয় করুণা আছে। গাঁজা আছে, উত্তেজনা আছে, বিলাসবহুল গুরুর আশ্রম আছে। যা নেই তা হল সহজে চেনা দৈনন্দিন জটিলতায় ভরা জীবনের সরল আনন্দ। ঈশ্বর, শান্তি এ কি ব্যবসার জিনিস? একি কারোর কাছে হাত পেতে চাওয়ার জিনিস? যা অন্যের কাছ থেকে পাই, তা অন্যের কাছেই হারাই। ঈশ্বর তো শুনেছিলাম নিজের মধ্যে, শান্তি সাধারণ বোধসম্পন্ন জীবনযাপনে, এতই দুর্মূল্য এগুলো? আসলে যা সহজ তাকে নানা ঘূর্ণীতে হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়া মানুষের পুরোনো অভ্যাস। বলে না দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না, এ তাই। যে শান্তিতে আছে সেই অশান্তি জাগিয়ে তুলে শান্তির খোঁজে বেরোয়।
আরেকদল রইল সেই প্রাচীন বৈষ্ণব, শৈব, শাক্তের দল। যারা প্রার্থনা করে, ঈশ্বরকে ভালোবাসতে চেয়ে নিজের ভক্তিতে নিজে মুগ্ধ হয়, নানা জায়গায় ঠকে, ঠকায়, ভোলে, আবার একই স্রোতে গা ভাসায়।
এ দেশে মানুষ ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে, কোটি টাকার মূর্তি হয় কোনো বিশেষ রাজার খেয়ালে, ঈশ্বর আর মানুষের লুকোচুরি খেলায় কোটি কোটি টাকার বন্যা বয়। এ আছে, আবার এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইও আছে। যে মানুষটা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনিই সব চাইতে বেশি করে চেয়েছিলেন ভারত অন্তত এই পরলোকচর্চা থেকে বেরিয়ে মাটিতে পা দিক।
সে চর্চা থাক আপাতত। এখন দেখি জন-প্রহসন, ইয়োগা চর্চায় আত্মলাভ, শান্তিলাভ, ঈশ্বরলাভের মহতী প্রচেষ্টার 'ইয়োগা পাড়া'য় আসা লোকজনের কেতা।
৮
১লা নভেম্বর ২০১৮, সকাল ১১.৫১
ভোর হল মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ শুনে। হোটেলের জানলার কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, সবুজ জল। আলো ফোটেনি এখনও পুরোটা। গায়ে চাদর জড়িয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। ঝড়ের বেগে বইছে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। কয়েক পা এগোলেই লছমন ঝুলা। গুটিগুটি পায়ে এগোলাম। হঠাৎ জনকোলাহল শুনে পিছনে ফিরে তাকালাম। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশজন দেহাতি মানুষ, পরমাত্মার নামগান করতে করতে লছমন ঝুলার দিকে এগোচ্ছে, সামনে ওদের পাণ্ডা, পরনে গেরুয়া, মাঝবয়েসী, কালো বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষ। লছমন ঝুলার সামনে তার দলকে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা কথা বললেন, শুনতে চেষ্টা করলাম না, দেখতে চেষ্টা করলাম। সাধুর পায়ে কম দামী রাবারের চটি একটা, তার ভক্তমহলের বেশির ভাগ মহিলার খালি পা। জামাকাপড় অতি সামান্য। তারা যত না শুনছে, তার থেকে বেশি চারপাশ দেখছে। মুখে ক্লান্তি ছাপিয়ে আনন্দের ছাপ, বিস্ময়ের ছাপ। তাদের সরিয়ে বেরিয়ে গেল তিনটে ঘোড়া, পিছনে অল্প বয়েসী ছোকরা, মালিক। ঘোড়াগুলোর পিঠে পাথরের বস্তা, একটা ঘোড়া একটা শুকনো পড়ে থাকা পাতা মুখ দিতে দিতে পিছন থেকে তাড়া খেল। ঘোড়ার দল ঝুলা কাঁপিয়ে এগিয়ে গেল। পিছনে চলল ভক্তের দল, হরিবোল, রাম রাম, রাধে রাধে...
ঝুলা কাঁপছে। খালি পায়ে আমার চোখের সামনে যেন সহস্র নরনারী এমন ভাবেই একটা সাঁকো পেরিয়ে যেতে চাইছে যুগ যুগ ধরে। কি আছে সাঁকোর ওপারে, কেউ জানে? জানি না। আমি ঝুলার মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম, হু হু করে বাতাস বইছে, আমার নীচ দিয়ে তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। খানিক দূরে সকালের সূর্য পাহাড়ের কোলে উঁকি দিচ্ছে, আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎই একজন সাধু এসে সামনে দাঁড়ালেন। বলা যায় যেন আবির্ভূত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ফ্রম ব্যাঙ্গালোর? বললাম, না, বেঙ্গল।
সাধু উচ্চ শিক্ষিত। এখন দশনামী সম্প্রদায়ের সাধু।
ধ্যান শিখতে চাই?
না, কার ধ্যান করব? আমি যে অবশেষে শূন্যকে ভালোবাসি। আমি মৌনতার সাধন করি না। আমায় মৌন কবিতা ছাড়া কেউ করে না। সাধু তোমার ধ্যানের ঈশ্বর কি কবিতা?
সাধু হাসল। সাধু বললেন, ঈশ্বরের আরেক নাম কবি।
নিশ্চয় তাই। কবিই তো। কবির ধ্যান তো রূপের সাধু, তুমি তো ধ্যান করো অরূপের।
গঙ্গার ধারে এসে বসলাম। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। তাদের কৌতুহল না পর্যটকে না পাহাড়ে, তাদের কৌতুহল সেই রাস্তায় ল্যাজ গুটিয়ে শুয়ে থাকা কুকুরে, ভটভট করে চলে যাওয়া নতুন মডেল বাইকে, কোনো আশ্রমের পাঁচিলের দেওয়াল বেয়ে ওঠা রঙিন পোকায়।
এক বন্ধু ডাকল লছমন ঝুলার পাশের একটা বইয়ের দোকানে। বাপ রে বাপ, কি বই কি বই!!! কার লেখা না নেই। আমি ক্রশওয়ার্ড, অক্সফোর্ড এর বইয়ের দোকানে গেছি, কিন্তু এমন বৈচিত্র আমি আজ অবধি দেখিনি বইয়ের। পকেট খসিয়ে বাইরে এলাম। রোদ ভালো চড়া। খবরের কাগজ নেই, গত তিনদিন ধরে 'দৈনিক জাগরণ' পড়ে চলেছি, নইলে 'অমর উজালা'। আজ তাও জুটল না।
আমি নাস্তিক না আস্তিক জানি না। যদি আস্তিক হই তবে ঈশ্বরের আমাকে প্রয়োজন না, আমার ঈশ্বরকে প্রয়োজন তাও জানি না। তবু সমস্ত ঘটনার পাশাপাশি যে উদাসীন হৃদয়ে হেলান দিয়ে নিরুত্তাপ এই প্রবহমানতার দিকে নির্লিপ্ত তাকিয়ে আছে তার সাথে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যায়। তার মুখে প্রসন্নতা অপ্রসন্নতা কোনোটাই নেই। সে আমার বাথরুমের দেওয়ালে অবাঞ্ছিত মাকড়সা নয়, সে আমার শোয়ার ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা করে থাকা পায়রাও নয়, সে কে? মনের মানুষ? মহাশূন্যের মানবিক ছায়া? জানি না, তাকে চাই, তবু তাকে চাইও না। তাকে চাওয়ার কিছু নেই। তাকে পেয়েই আছি। তবু যেন পাওয়া হল না।
৯
৫ই নভেম্বর ২০১৮, দুপুর ১২.48
এখন বারোটা পঁয়তাল্লিশ আমার ঘড়িতে। মহাত্মা গান্ধী রোডে একের পর এক স্ট্রিট লাইট জ্বলে। "এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার?" সে তো জটিলেশ্বরবাবু সন্ধ্যেবেলা রবিশঙ্করের ভাটিয়ার শুনে লিখে ফেলেছিলেন... আজ কলকাতায় কোন রবিশঙ্করের ভাটিয়ার বাজল এই ভর দুপুরে?
৫ই নভেম্বর ২০১৮, সন্ধ্যে ৭.৪৯
স্টেশানের উপর বসে গোটা পরিবারটা। খবরের কাগজ পাতা হল, একটা উঁচু জায়গায়, যেখানে বসে আরকি। মুড়ি ঢাললেন মা সেই পাতা খবরের কাগজে। বড় ছেলে শশা ছাড়িয়ে ফেলল। ছোটো ছেলে একটা প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেট থেকে চানাচুর আর বাদাম ঢালল। স্বামী একটু দূরে বসে দেখছেন। ভোরের জশিডি স্টেশান।
সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুড়ি চিবাতে লাগল। একজন পাগলী ভিখারি হাত পাতল, মা তাকে দুই মুঠো মুড়ি বাড়িয়ে দিলেন। সে প্রসন্ন মনে একটু দূরে বসে খেতে লাগল। কয়েকটা কুকুর একটু দূরে বসে, কিছুটা উৎসুক, কিছুটা নির্লিপ্ত। সকালের সূর্য উঠেছে বেশ খানিকক্ষণ হল। স্টেশানের পিছনের সিমেন্টের জালের ফাঁক থেকে সে আলো স্টেশানের মেঝেতে আলোর জালি তৈরি করেছে। মায়ের আঁচলের উপরও সে জাল ঘিরে রেখেছে, যেন আলোর আদর। প্রবল প্রেম, তার খানিক তীব্রতা কমিয়ে ঘরের স্নেহ হয়, সে মহামানব খোঁজে না, সে খোঁজে নিতান্ত ঘরোয়া দোষেগুণে ভরা আটপৌরে মানুষ, সাধারণ মানুষ।
ছোটো ছেলেটা দুরন্ত। মা তাকে মুঠো করে খাওয়াচ্ছে, সে হাত পেতে আলোর জালিতে আলো ধরার চেষ্টা করছে। ছোটো ছোটো দুটো হাত মায়ের আঁচলের উপর পড়ে থাকা আলোর জালিটাকে ধরতে চাইছে, মা আবার পিছন দিক থেকে তাকে ধরে এনে আবার মুঠো করে মুড়ি ভরে দিচ্ছে।
আমার ট্রেন বাড়ি ফেরার পথে। আমার সমস্ত পড়াশোনা, জানা, চিন্তা সব কিছু এই আলোর জালির কাছে এসে হারিয়ে যায়। আমিও সব ভুলে ওগুলোকে মুঠোর মধ্যে ভরতে চাই। না ধরতে পারলে কান্না পায়। হারিয়ে গেলে অভিমান হয়। এই আমিটাই আসল আমি। বাকিটা সাজানো, মিথ্যা।
ইঞ্জিন হুইসেল দিল। বগিতে পড়ল হ্যাঁচকা টান। চলন্ত ট্রেনের দিকে হাফপ্যান্ট পরা ছোটো ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে। তার পিঠের উপর আলোর জালি। তার মা এক মুঠো মুড়ি নিয়ে আমাদের ট্রেনের চলে যাওয়ার অপেক্ষায়, ছেলেটার মুখে গুঁজে দিতে হবে তো।
স্টেশান ছাড়তেই বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আলোয় আলো। দাম্ভিক সূর্য একা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি একটা গাছ খুঁজছি, যে তার পাতার ফাঁক দিয়ে আলোর জালি বানিয়ে দেবে। এত আলোতে বিশ্রাম কই, ছায়া না হলে স্নেহ কই?
[ছবিঃ লেখক, তন্ময় ব্যাপারী]