Skip to main content

১৮৯৫ সালে তারিখহীন একটি চিঠিতে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণানন্দকে লিখছেন, "এক্ষণে দেখিতেছি যে, ওই ঘন্টাপত্র লইয়া রামকৃষ্ণ অবতারের দল বাঁধিবে এবং তাহার শিক্ষায় ধূলিনিক্ষেপ হইবে... আমি যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য এবং তোমরাও যে তাই, এইটি বই লিখে ছাপাতে যত্ন তো যথেষ্ট হয়েছে; কিন্তু আমি যে আজ ছ'বৎসর ঘন্টাপত্র ত্যাগ করার জন্য বলছি, তাতে কারো কানপাত নাই। আমি একমাত্র কর্ম বুঝি পরোপকার, বাকি সমস্ত কুকর্ম।”
        স্বামীজীর আরেকটা চিঠি ১৮ই নভেম্বর ১৮৯৪ সালে লেখা রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে, "আমার দৃঢ় ধারণা কোন ব্যক্তি বা জাতি অপর জাতি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়া বাঁচিতে পারে না। আর যেখানেই শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা বা নীতি সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া এইরূপ চেষ্টা করা হইয়াছে, যেখানেই কোন জাতি আপনাকে পৃথক রাখিয়াছে, সেখানেই তাহার পক্ষে ফল অতিশয় শোচনীয় হইয়াছে।
আমার মনে হয়, ভারতের পতন ও অবনতির এক প্রধান কারণ - জাতির চারিদিকে এইরূপ আচারের বেড়া দেওয়া। প্রাচীনকালে এই আচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল - হিন্দুরা যেন চতুষ্পার্শবর্তী বৌদ্ধদের সংস্পর্শে না আসে। ইহার ভিত্তি অপরের প্রতি ঘৃণা। 
        প্রাচীন বা আধুনিক তার্কিকগণ মিথ্যা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া যতই ইহা ঢাকিবার চেষ্টা করুন না কেন অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না।”
        ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লিখছেন, "হিন্দুধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। ... আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু। সেইখানে পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে ... অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই … ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল।”
        ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ 'প্রবাসী' পত্রিকায় লিখছেন, “হিন্দুসমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম। এই কারণে আচারের পার্থক্যে পরস্পরের মধ্যে কঠিন বিচ্ছেদ ঘটায়। মৎস্যাশী বাঙালীকে নিরামিষ প্রদেশের প্রতিবেশী আপন বলে মনে করতে কঠিন বাধা পায় ... যে চিত্তবৃত্তি বাহ্য আচারকে অত্যন্ত বড় মূল্য দিয়ে থাকে তার মমত্ববোধ সংকীর্ণ হতে বাধ্য।”
        রবীন্দ্রনাথ ১৮৯২ সালে 'সাধনা' পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় লিখছেন, 'আচারের অত্যাচার' নামক প্রবন্ধ। লিখছেন, "ইহাকে স্পর্শ করিব না, তাহার ছায়া মাড়াইব না, অমুকের অন্ন খাইব না, অমুকের কন্যা গ্রহণ করিব না, এমন করিয়া উঠিব, অমন করিয়া বসিব, তেমন করিয়া চলিব, তিথি নক্ষত্র দিন ক্ষণ লগ্ন বিচার করিয়া হাত পা নাড়িব, এমন করিয়া কর্মহীন ক্ষুদ্র জীবনটাকে টুকরো টুকরো করিয়া কাহনকে কড়াকড়িতে ভাঙিয়া স্তুপাকার করিয়া তুলিব এই কি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। হিন্দুর দেবতা, এই কি তোমার বিধান যে, আমরা কেবলমাত্র 'হিঁদু' হইব, মানুষ হইব না।”


        উপরের উদ্ধৃতিগুলোর সংখ্যা কিছু বেশি হল, কিন্তু না দিয়ে উপায় ছিল না। বিবেকানন্দের প্রথম পত্রের আশঙ্কা যে বহুলাংশে সত্যি হয়েছে সে কথা অতি অন্ধও বুঝতে পারে। যে মাটিতে 'যত মত তত পথ' মন্ত্রের উদগাতার জন্ম, সে মাটি আজ দাঙ্গার ভয়ে আশঙ্কায় আতঙ্কে দিনযাপন করছে। এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? বিবেকানন্দ বহু চিঠিতে তার গুরুভাইদের সাবধান করছেন, চিরটাকাল চেলারা তার গুরুর নাম বড় করতে গিয়ে শিক্ষাকে ডুবিয়েছে। অনুরোধ করেছিলেন এক্ষেত্রে যেন তা না হয়। বাস্তব কি আমরা সবাই জানি। দল বাঁধা হল, সম্প্রদায় হল শুধু না, কয়েক দশক আগে রামকৃষ্ণ অনুগামীদের একটি পৃথক সম্প্রদায়ভুক্ত করার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন কোর্ট কাছারি পর্যন্ত করল।
        কারণ একটাই, আমাদের কাছে দর্শন সত্য উপলব্ধির চাইতে আচার প্রধান। যা কিছু প্রাচীন তাই পবিত্র। তাই যখন বাসন-কোসন আবিস্কার হয় নি, পাতায় খাওয়ার রেওয়াজ ছিল, সেই পাতায় খাওয়া আজ পবিত্র আচার। যিনি যত উচ্চ, যত গভীর, যত বিশ্বজনীন শিক্ষাই দিন না কেন, তা যদি আমরা আমাদের সংকীর্ণ আচারের মধ্যে না নিয়ে আসতে পারি তা যেন প্রতিষ্ঠা লাভ করল না। আমরা মুখে বলি “হাঁ বটে, কিন্তু... কৃষ্টিটা তো থাকে না।” তাই অবশেষে কৃষ্টিটাই রয়ে গেল, বাকি সব হয় শিকেয় তোলা থাকল, নয় অনভ্যাসে অচর্চায় দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে দৈনন্দিন জীবনে তার গুরুত্ব হারালো। আমরা প্রাচীন আর্যসমাজের গৌরবচ্ছটায় নিজেদের অজ্ঞতায় আত্মপ্রসাদ লাভ করে আত্মতুষ্ট থাকলাম, বাকি বিশ্বকে উপেক্ষা করলাম, করুণা করলাম।
        আশ্চর্য লাগে আমার আশেপাশে এখনও বহু মানুষ একে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে খাওয়াটাকে চলাটাকে পরম পূণ্যের কাজ বলে মনে করেন। তার পিছনে তাদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তিরও অভাব নেই। যে গঙ্গাজল নিশ্চিন্তে একগ্লাস পান করতে মনে ভয় সেই গঙ্গাজলে ঠোঁট ডুবিয়ে 'ওম্‌ বিষ্ণু ওম্‌ বিষ্ণু' বলে পবিত্র হতে মনে সংশয় জাগে না। সে আত্মায় বা বিষ্ণুতে জীবাণুর সংক্রমণ হয় না বলেই হয়তো। তবুও ওটা মানতেই হবে, কারণটা আচার। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সমাজে গরু হত্যা করে কিম্বা অষ্টাদশ বর্ষীয়া কন্যার বিবাহ না দিয়ে একঘরে হতে হয়, অথচ মানুষ খুন করে সমাজে অনায়াসে ঠাঁই পাওয়া যায়। আচার এমনই বিষম বস্তু।
        যার অস্তিত্ত্ব আছে, যার অনুভব আছে, যার যুক্তি আছে, তাকে নিয়ে সামনের দিকে এগোনো যায়। কিন্তু যার উৎস শুধুমাত্র কাল্পনিক ভয় তাকে নিয়ে এগোনোও যায় না, নিজেদের মধ্যে শান্তিতে বসবাস করাও যায় না। তাই দেশের আচার, রাজ্যের আচার, পাড়ার আচার, গোত্রের আচার, পরিবারের আচার, বিভিন্ন গুরুদের আচার ... কোথায় যাবা? কোন একটা থেকে বাঁচবে যদি, একশোটা এসে ঘাড়ে পড়বে। অবশেষে কোন একটা তথাকথিত আধুনিক আচারের পায়ে স্বাধীন চিন্তাবোধ বিসর্জন দিয়ে 'হিঁদু' হয়ে উঠতে হয়, উঠতেই হয়।
        গুরু উচ্চাসনে বসে বললেন, ওরে মাছ মাংস পিঁয়াজ রসুন ছাড়। শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন, কেন গুরুদেব? গুরুদেব প্রসন্ন হেসে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ওতে মানুষের আয়ুক্ষয় হয়। শিষ্য গদগদচিত্তে গুরুকে প্রণাম করে সব সংশয় মিটিয়ে ফিরে গেল। গুরু আদেশ করলেন, ওরে তামাকটা আন। এত অবধি পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন এল, তামাকে কি আয়ু বাড়ে? যদি প্রশ্ন করা হয়, তবে আমার মেসেঞ্জার ভর্তি অকল্পনীয় আর্যবিজ্ঞানীদের বহু আয়াসসাধ্য বিজ্ঞানপর্যবেক্ষনসম্ভুত ফল ও তার ব্যবহার ইত্যাদির তথ্যে ভরে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, কুয়াশার চাইতে অন্ধকার ভাল। সত্যিই তাই। ঘরে যখন লো ভোল্টেজ হয় তখন বিরক্ত হয়ে ভাবি, এর চাইতে কারেন্ট যাক, অন্তত মোমবাতিটুকু জ্বেলে পুরো আলোটুকু পাই। লো ভোল্টেজের মুশকিল হল আবছা আলোয় সব কিছু স্পষ্ট দেখাও যায় না, ওদিকে কাজ চলে যাচ্ছে বলে মোমবাতি জ্বালতেও হাত সরে না। মোটামুটি কাজের এই নমুনা আমাদের মন্দির থেকে বাড়ী, বিদ্যালয় থেকে শ্মশানঘাট - উদাহরণে উদাহরণে ভরপুর।
        তাই যে মানুষটার রক্তমাংসের শরীর রসিক মেথর থেকে আরম্ভ করে গিরীশ ঘোষ অবধি সকলের স্পর্শযোগ্য ছিল এবং যার থেকে প্রেমাশীষ পাওয়ার যোগ্য ছিল, আজ সেই মানুষটার মর্মরমূর্তি কাঁচের আড়ালে বোধহয় হাঁপিয়েই উঠছে। যে মানুষটা নবদ্বীপ থেকে সারা ভারত পাগলের মত ছুটে বেরিয়েছিল, আজ তুলসীমালা চন্দন তিলক, নিরামিষ ভোজন ইত্যাদি তত্ত্বের জনক হিসাবেই বোধহয় মাটিতে পাথরে মাথা ঠুকছেন। বুদ্ধ দেশছাড়া, কবীর লুপ্তপ্রায়। কারণ, এদের আচারে বাঁধতে বোধহয় ততটা সুবিধে করা যায় না। ভয় হয় আজ থেকে দুশো বছর পরে রবীন্দ্রনাথের নামেও না "ওম্‌ রবীন্দ্রনাথায় নমঃ” মন্ত্রে দীক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়, এবং পঁচিশে বৈশাখ খিচুড়ি অন্নের ব্যবস্থা করা হয়। কি কি পোশাকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হবে এবং কি কি ফুল ব্যবহৃত হবে সে সব তো ইতিমধ্যে আচারের মধ্যে এনে ফেলেছি, বাকিটাও বোধহয় এসে পড়ল বলে।