Skip to main content

সে মেলা বছর আগের গপ্পো। তখন আমাদের দেশ পরাধীন। একজন বাবু আপিস থেকে টমটম চড়ে বাড়ি ফিরছে। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় দু একটা সদ্য শেখা বিদেশী গানের সুরও ভাঁজছে। কথাগুলো বোঝে না সব, কিন্তু সুরটার মধ্যে যে একটা আভিজাত্য আছে বেশ বোঝে।

হঠাৎ বলল, অ্যাই... অ্যাই... গাড়ি রোকো.....

কেন? না, বাবু দেখল, এক সাহেব, তার বাড়ির সামনে, মাটিতে উবু হয়ে বসে কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছে, আগাছা কাটছে।

=====

বাবু অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ফিরল। জুতো খুলে ঠাকুরঘরে গিয়ে যীশু প্রণাম করল। কাঁসার থালায় রাখা দু টুকরো কেক খেলো। কফি খেল। কিন্তু মনটা ভালো লাগল না।

গিন্নী এসে বসে বলল, কি হয়েছে গো?

বাবু চুপ করে বসে। কোনো উত্তর দিল না।

=======

পরেরদিন বাবু আপিস থেকে ফিরল হাতে একটা নতুন কাস্তে নিয়ে। গিন্নী বলল, এ আবার কি গো?

গিন্নী কর্তাকে একটু ভয়ই পায়। একবার হল কি, তিনি কোন এক লেকচারে শুনে এসেছেন আমাদের ধম্মোই নাকি আমাদের সব খেলে। ও দেশের যীশুকে না ভজলে এখন গতি নেই। আমাদের স্বর্গতেও নাকি এখন লালমুখোরা। গিন্নী সব ঠাকুরদেবতা সরিয়ে যীশুর পট কিনে আনল, সিংহাসনে বসালো কর্তার আদেশে। বাড়িতে অষ্টপ্রহর কীর্তন হল সাতদিন, যীশুর নামে। এক রবিবার থেকে আরেক রবিবার। থুড়ি, আটদিন। পাড়ায় সবাই জানল যে তারা খেষ্টান হয়েছে।

কিন্তু গিন্নী পড়ল মহা ফাঁপরে। ধ্যানে খালি খালি কৃষ্ণ কালী চলে আসছে। উপায় কি? উপায় হল। একদিন গুরুদেব স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, এতে ভাবনা কি রে? সব জানবি এক। তুই যীশুকে গোপালভাবে সেবা করে যা। তিনি সব বুঝবেন।

গিন্নী তাই শুরু করল।

এতো গেল পুরোনো গল্প। আজ আবার কাস্তে কেন? এ আবার নতুন কি খেয়াল চাপল কর্তার মাথায়!

গিন্নী দেখে কর্তা ঘরে নেই। গেল কই? ঠিকে ঝি বলল, বাবুকে দেখলাম বাগানে যাচ্ছেন….

এই রোদে বাগানে?

গিন্নী গিয়ে দেখে কর্তা কাস্তে দিয়ে আম, জাম, কাঁঠাল সব গাছ ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কোপাতে শুরু করেছে।

গিন্নী দৌড়ে গিয়ে বলল, কি করো… কি করো… এ যে আমাদের বাপ ঠাকুদ্দাদের লাগানো গাছ গো… ধম্মে সইবে না….

কর্তা নিমগাছটায় কোপ মারতে মারতে বলল, আরে ওইতেই তো আমাদের সব খেলে…. সেদিন এক সাহেবকে দেখলাম উবু হয়ে বসে নিজে নিজে বাগানের সব কাটছেন….

কি কাটছেন….?

ওই ঘাসটাস….

আরে উনি নিশ্চয়ই আগাছা কাটছেন…. কিন্তু এগুলো তো আগাছা না গো…..

শোনো কোনটা আগাছা আর কোনটা আগাছা না, এ ঠিক করার বুদ্ধি আমাদের নেই…. মুখ্যু মেয়েমানুষ তুমি…. আর তোমাদেরই বা কি দোষ… সেদিন একজন সাহেব বলছিলেন, জন্মাতো আমাদের দেশে ভলতায়ারের মত একজন মনীষী… সব অশিক্ষা দূরে চলে যেত গো….

গিন্নী দুবার ঢোক গিলে বলল, মানে যীশুতে হবে না গো?

কর্তা বলল, না গো…. তুমি মনে কষ্ট পাবে বলে বলতে পারিনি… আসলে আমাদের নাস্তিক হতে হবে….. মানে যীশুকেও সরিয়ে ফেলতে হবে…..

======

গিন্নী যীশুর পট তুলতে তুলতে চোখের জলে ভাসল। এতদিনে মায়া পড়ে গেছে একটা। নাড়ু না খাক, লাড্ডু না খাক, কেক তো খায়! কিন্তু কি আর করা। যীশুর পট কাপড়ে মুড়ে ভাঁড়ার ঘরের তাকে তুলে দিয়ে এলো। যেখানে বাকি দেবদেবীরা সব আছে। কিন্তু ভলতেয়ারের ছবি কোত্থেকে পায়? তার পুজোর নিয়ম নেই। কর্তাও স্পষ্ট করে কিছু বলে না। সামনের বাগানটা পুরো খাঁ খাঁ করছে। একটা গাছও নেই। এদিকে মনের মধ্যেটাও শূন্য। গুরুদেবকে ডাকে গিন্নী আর বলে কি করব এখন আমি, তুমিই বলো…..

গুরুদেব আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, তুই ভাবিস কেন…. তুই বলবি ওগো আমার মন, হৃদয়, বুদ্ধির সাক্ষী…. তুমি যে নেই সেটা আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দাও…..

গিন্নী ভয় পেয়ে বলল, কিন্তু সে যদি "আছি" বলে সামনে এসে দাঁড়ায়….

গুরুদেব বললেন, তুইও "নেই" বলে পিছন ফিরে দাঁড়াবি…..

আবার যদি সে ওদিকেও সামনে এসে দাঁড়ায়…..

গুরুদেব হাসলেন…. বললেন, দশদিকে তুই ঘুরলে সেও যদি দশদিকে ঘোরে…. তবে তো সে শূন্যই হল, এক পাক ঘুরে…. তুই জানবি ওই শূন্যই নাস্তিকতা….. কেউ বলে শূন্য… কেউ বলে পূর্ণ!

======

কর্তা দেখে গিন্নীর পুজোপাঠ নেই তাও কি করে এত আনন্দে থাকে? কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করতে কোথায় একটা লাগে। নিজেকে বোঝায়… ও মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কদ্দূর হবে।

একদিন খেতে বসে গিন্নী বলল, হ্যাঁ গো, তোমার সে কাস্তে হাতে সাহেব কি শুধুই কাটেন… কোনো গাছ লাগান না?

কর্তার মাথায় কথাটা বিঁধল। তাই তো। খোঁজ নিতে হবে। নইলে কাস্তে আছে, অথচ কোনো কাজ নেই কি করে হয়? সহ্যও হচ্ছে না।

পরেরদিন সেই সাহেবের বাড়ির এক চাকরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ওহে তোমাদের সাহেব কি বাগানে কিছু লাগিয়েছেন?

চাকর বলল, জরুর লাগিয়েছেন… আম, জাম, কাঁঠাল, নিম….

কর্তা বলল, আর কাস্তে? উয়ো নেহি চালাতা?

চাকর বলল, জরুর.. জরুর… আগাছা হোনে সে চালাতা…..

=====

কর্তা বিমর্ষ হয়ে শূন্য বাগানে বসে। আজ আপিসে মন বসছিল না বলে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ঘরে না ঢুকে বাগানেই বসেছে।

হঠাৎ শুনল গিন্নীর গলার আওয়াজ। বাড়ির পিছনের দিকে। কর্তা গিয়ে দেখে গিন্নী দুজন চাকরকে নিয়ে পিছনের বাগানে দাঁড়িয়ে, কি সব বলছে। কাছে গিয়ে দেখে বেশ কিছু চারাগাছের গোড়ায় মাটি ঠিক করছে চাকরেরা।

কর্তা বলল, এগুলো কি গো?

গিন্নী প্রথমে একটু চমকে গেলেও, নিজেকে সামলে বলল, আম, জাম, কাঁঠাল আর নিম। বড় হোক তারপর কেটো। আমি আবার লাগাবো। এমন করে সব কেটে শূন্য বাগান রাখলে ধম্মে সইবে না যে!

কর্তার চোখে জল এলো। নিজেকে সামলে, গিন্নীকে বলল, আমি তোমার ঈশ্বরকেও কেড়েছি, না গো….

গিন্নী বলল, পারোনি…. আমিও পারিনি…. ঈশ্বর না থাকুন… মানো না মানো… সংসারে ধম্মো বলে কিছু একটা আছে সেটা তো মানো…. ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই? সে হয়? ও তুমি কি আর কাস্তে দিয়ে কাটতে পারো…. গাছগুলো বড় করি… তুমি কেটো তারপর…..

কর্তা কিছু বলল না। ঘরে গিয়ে কাস্তেটা হাতে নিয়ে বসল। কাস্তে দিয়ে কি কাটলে ধম্মে সয়?.... কাকে জিজ্ঞাসা করবে? গিন্নীকে? থাক…. নাকি জেনেই নেবে…. হ্যাঁ গো…. শুনছ….?