দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন ---"সচেতনতা একটি রোগ বিশেষ"----
আমার মনে হয়, সচেতনতা নয়,গাম্ভীর্য। সচেতনতার এমন একটি গম্ভীর গ্রাম্ভারি ভাব রয়েছে যা চেতনার স্বচ্ছন্দ বহমানতাকে কোথাও একটা রুদ্ধ করে দেয়। যখনই আমি, আপনি কোনো একটি বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়ি, আমরা আমাদের চেতনা সম্পর্কে নিজেদের অগোচরেই খুব সচেতন হয়ে যাই--- মূল বিষয় সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে।
কিন্তু জীবন তো শুধু এই সচেতনতা নিয়েই নয়। বস্তুত, জাগতিক জীবনে সচেতনতার ভূমিকা অতি অল্প। জীবন আসলে সচেতন এবং অচেতনের মধ্যে এক খণ্ডিত যাপন, যার ভিতরে সচেতনতা স্বল্প স্থান অধিকার করে রয়েছে, আর আমাদের অনুভব, আবেগ, সংবেদ, সবটুকু রয়েছে অচেতন মন জুড়ে। যখন আমরা নিজেদের বাধ্য করি নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপারে ভাবতে বা অনুভব করতে, আমরা জীবনের সচেতনতার সেই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে যাতায়াত করি, যা সীমাবদ্ধ। যখন চেতনাকে করে দিই মুক্ত, মন হয়ে যায় নিষ্ক্রিয়, তখন অবচেতন দখল নেয় মনের। নিষ্ক্রিয় মন তখন মানসপটে দেখে চলে অজানা চলচ্চিত্র---বিভিন্ন অনুভব, আবেগ, স্বপ্ন, ইচ্ছে, রাগ, যন্ত্রণা, আনন্দ--- ছবির মতো ভেসে যায় অজানা উৎস থেকে অচেনা গন্তব্যে। আমাদের কিছু বিচার করার প্রয়োজন নেই, আতঙ্কের কোনো অবকাশ নেই, ঘটনা-দুর্ঘটনার রাশ নিজেদের হাতে নেওয়ারও দরকার নেই কোনো। অস্তিত্বহীন নয়, অস্তিত্বের নিগড়মুক্ত হয়ে আমাদের শুধু দেখে যেতে হবে।
পৃথিবীর সব তত্ত্ব আমরা প্রমাণ করতে পারবো না। যুক্তি-তর্কের নিজস্ব সীমা রয়েছে, সেটা বুঝতে আমাদের প্রয়োজন প্রজ্ঞার। তার জন্য আমাদের সক্রিয় সচেতনতাকে শিথিল করতে হবে, ঠিক যেমন আমরা মাংসপেশিকে শিথিল করি। নিজেদের উপর নিজেদেরই চাপানো শর্ত, নিজেদেরই স্থির করে দেওয়া লক্ষ্য, রক্ষণশীলতার অচলায়তন থেকে মুক্ত করতে হবে নিজেদের। সচেতন মন সর্বদা একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার ঘেরাটোপে পড়ে কলুষিত হয়, কিন্তু আমাদের অবচেতন সে কলুষ থেকে মুক্ত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে আমাদের অবচেতনকেও গ্রাস করছে, আর এক দুরারোগ্য দুশ্চিন্তা, দুরপনেয় শঙ্কার মেঘে ছেয়ে ফেলছে মনের আকাশ--- বিষিয়ে তুলছে আভ্যন্তরীণ চেতনার শিকড়।
আমাদের প্রথম কাজ হলো, সচেতন আর অচেতন মনের মাঝে একটা পথ তৈরির চেষ্টা করা। যখন আমাদের অবচেতন মন সৎভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে, আমাদের চেতনাও ধনাত্মকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠবে। আর সেই সক্রিয় সচেতনতা কখনোই তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সংযোগহীন হতে পারে না, কারণ সে তার অনুপ্রেরণা, তার নিজের অবচেতন থেকে কোনো সময়ই আর বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যে অবচেতনকে এতটা আশকারা দিয়ে খোলা ছেড়ে দেওয়া কি যথেষ্ট ঝুঁকির নয়? উত্তর "না" এবং "না"। বহু শতাব্দী ধরে এক ভিত্তিহীন ভয় আমাদের চিন্তাকে স্থবির করে রেখেছে, যে অবচেতন মন হলো সাক্ষাৎ শয়তান। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে যুগে যুগে কালজয়ী সাহিত্য, শিল্পকলা, এমনকি কত অসাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও জন্ম নিয়েছে এই অবচেতনের অতল, গহীন গহ্বর থেকে। কিন্তু অবচেতন সম্পর্কে এই নির্বোধ আতংক আমাদের সমাজকে কেবল দিয়েছে ধর্মের অজ্ঞানতা, বোধহীন হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, কুসংস্কার, জ্যোতিষ, ফেংশুই প্রভৃতি--- মানুষের নির্বুদ্ধিতার চরম কিছু নিদর্শন।
সুতরাং, আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো এই অবচেতনকে সবরকম শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা--- সচেতন গাম্ভীর্যকে পাহারাদারের ভূমিকা থেকে মুক্তি দেওয়া।
আমাদের আর কোনো পাহারার প্রয়োজন নেই,--- না ঈশ্বরের নামে পাহারা, না নীতিপুলিশির পাহারা, না সংস্কৃতির পাহারা, না মনীষীদের জীবনদর্শনের পাহারা। এই দুমুখো, সুবিধাবাদী সমাজের দ্বিচারিতা দিয়ে তাঁদের যথেষ্ট ভুয়ো শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছি, এবার আপন অস্তিত্বের গভীরে ডুব দেবার পালা, নিজের সত্ত্বার তলকে ছোঁয়ার পালা, আগল ভেঙে বহতা জীবনের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেবার পালা। তবেই তো দেখতে পাবো, যে সেই অস্তিত্বের আয়নায় নেই কোনো শঙ্কা, কোনো পাহারা, কোনো প্রতিযোগিতার দূষণ। আছে শুধু ভালবাসা, মায়া মমতা আর সক্রিয় স্বতস্ফূর্ততা--- জীবনীশক্তিতে ভরপুর।
আজ আত্মহত্যা-বিরোধী দিবস। এ দিন উদযাপনের নয়, নয় প্রচারেরও। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেবার--- যে আজ শান্ত প্রজ্ঞার উপর হিংস্র বুদ্ধিমত্তার আক্রমণকে ঠেকানোর দিন, মানুষের স্বাভাবিক মমত্বের উপর আত্মম্ভরিতার আগ্রাসনকে ঠেকানোর দিন, অর্থহীন আত্মরতির হাত থেকে আপন সুস্থ চেতনাকে মুক্ত করার দিন।
জীবন তার অসংখ্য রঙের, ভিন্ন স্বাদের, প্রিয়- অপ্রিয় সব রকম অনুভব নিয়ে খেলা করুক আমাদের সঙ্গে। আমাদের সক্রিয় চেতনা যেন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে, তৎপরতার সঙ্গে জীবনের এই চ্যালেঞ্জ হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারে।
জীবনের জয় হোক।
[অনুবাদিকাঃ Sukanya Bandyopadhyay]