Skip to main content
 
 
 
'War and Peace' শেষ করার পর মনে হল, উপন্যাসটার শেষ অধ্যায়গুলোতে টলস্টয় আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক দর্শনে এসে দাঁড়ালেন কোথাও। আমি 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসটার কথা বলছি। দু'জনেই কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নায়ক বা খলনায়ক বলতে রাজী নন যেন কোথাও। যেন সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তবে কে কেন্দ্রীয় চরিত্রে? সময়।
 
হ্যাঁ সময়। টলস্টয় তাঁর এই দীর্ঘ উপন্যাসটিতে দুটো ছবি আঁকছেন একই সাথে। এক, যুদ্ধক্ষেত্র; দুই, সাধারণ অসামরিক জীবনযাত্রা।
নেপোলিয়নের মস্কো অভিযান - এই হল উপন্যাসের একটি গোলার্ধ। আর পাঁচটি প্রধান পরিবার তার সাথে জড়িত নানান মানুষদের নিয়ে বাকি গোলার্ধ। মাঝে অবশ্যই এই দুই গোলার্ধের একটা মিলিত অংশ আছে। মানে ওভারল্যাপিং আছে। 
তো যেটা বলছিলাম, মূল কথাটা সময়। যার আরেকটি রূপ পরিস্থিতি। আমাদের সব সিদ্ধান্তই কি একান্ত ব্যক্তিগত? স্বাধীন ইচ্ছা প্রসূত? শুধুমাত্র নেপোলিয়ান চেয়েছিলেন বলেই কি এতবড় ধ্বংসলীলা রাশিয়া জুড়ে ঘটে গিয়েছিল? সাধারণ মানুষের কোনো সম্মতি ছিল না? 
আমরা ছোটবেলায় দূরদর্শনে মহাভারত দেখেছিলাম। শুরুতেই একটা চাকা মহাকাশে ঘুরত, পিছনে অস্পষ্ট একজন ঋষির অবয়ব, যে নিজেকে কালচক্র ঘোষণা করে মহাভারতে কথকের ভূমিকা নিয়েছিল। এক্ষেত্রেও তাই। টলস্টয় যেন সেই মহাকালের ভূমিকায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানব প্রচেষ্টা তাঁর নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। সে নেপোলিয়ানের দ্বন্দ্বঘন রাতের বর্ণনা হোক, কি একজন ষোড়শীর প্রণয়ের মান-অভিমান হোক, কি কোনো বিধবা রমণীর নিজের একমাত্র পুত্রসন্তানের ভবিষ্যত দুশ্চিন্তা হোক। টলস্টয়ের বর্ণনায় সবাই সমান গুরুত্বশালী। ঠিক আজও যেমন উরিতে আক্রমণ যতই ইতিহাসের চোখে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হোক না কেন, আমার জীবনে সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত কোনো সিনেমার টিকিট পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়, কিম্বা আমার পরীক্ষার রেজাল্টের দুশ্চিন্তা ইত্যাদি তার চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু ইতিহাসে সে কথাটা লেখা থাকবে না। লেখা থাকবে শুধুই উরির আক্রমণ। টলস্টয় তা করেননি। তাঁর লেখায় সবার গুরুত্ব সমান। এইখানেই তিনি অসামান্য। 
আমার এই ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক জীবনের মধ্যে যোগসূত্রটি কি তবে? সেই একই উত্তর - সময়। রাশিয়ার সীমানায় যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে, তখনও দেখা যাচ্ছে মস্কোর জীবনযাত্রায় প্রথম প্রথম কোনো প্রভাবই পড়ছে না তার। প্রভাব পড়ছে শুধু আলোচনায়। বাকি প্রেম, হিংসা, ষড়যন্ত্র, আমোদ, উল্লাস একই ধারায় বয়ে চলেছে। 
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছেন, আমাদের জীবনগুলো যেন কোন এক অদৃশ্য হাতের অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, টলস্টয়েরও বক্তব্য খানিকটা এক। মজার কথা দেখুন, একজন পুরোদস্তুর আস্তিক (টলস্টয়), অন্যজন তেমনই নাস্তিকবাদে ঝোঁক (মানিকবাবু)। কিন্তু দীর্ঘ মানব জীবনের ইতিহাস লিখতে বসে শেষে দুজনের উপলব্ধিই সেই একই জায়গায়। কেউ বলছেন ভাগ্য, কেউ বলছেন ঈশ্বরের ইচ্ছা। 
শোপেনহাওয়ার নামক প্রখ্যাত দার্শনিকের প্রধান বিষয় - ইচ্ছা। মজার কথা টলস্টয় বলছেন, তিনি এই উপন্যাসটি লেখার সময় ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এই মহান দার্শনিকের চিন্তা-ভাবনার দ্বারা। তাই কি এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই লেখাটার অবতরণ? জানি না। কারণ ওনার শেষ, খুব বিতর্কিত উপন্যাস 'রেজারেকশান' এর প্রধান চরিত্র যতটা না পরিস্থিত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তার থেকে বেশি নিজের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত। যে বিবেক-বুদ্ধি খৃষ্ট জীবনের ছাঁচে নিজেকে গড়তে চায়। চার্চের খ্রীষ্ট না। মানবতার বাণীরূপ খৃষ্ট। এই উত্তরণের পথটা টলস্টয়ের সব লেখাতেই তথা ওঁর ব্যক্তিগত জীবনেরও একটা প্রধান সুর। তাই স্বাধীন ইচ্ছা বনাম অনিবার্যতাবাদ-এর কোনো সহজ সমাধান করা এক কথায় অসম্ভব বলেই উনি এই উপন্যাসের অন্তিম লাইনে বলছেন, এমন একটা স্বাধীনতাকে পরিহারের সময় এসেছে যার কোনো অস্তিত্ব নেই, আর এমন একটা পরাধীনতার (আনুগত্যের?) সময় এসেছে যার সম্বন্ধে আমরা সচেতন নই। 
মনে পড়ে গেল রামকৃষ্ণদেবের সেই উদাহরণ, একটা গরুকে দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে। যতটা যেতে পারে ততটাই তার স্বাধীন ইচ্ছা। কিন্তু তা পূর্ব নির্ধারিত। 
লেখাটা আর বিস্তারিত করব না। শুধু কয়েকটা কথা বলে ইতি টানি। (কারণ এই ইচ্ছা সংক্রান্ত একটা লেখা সব ঠিক থাকলে আগামীকাল আলোচনা করার ইচ্ছা আছে, একটা আলাদা প্রবন্ধে।) আমার অনেক বন্ধু আছেন ফেসবুকে যাঁদের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই, অথচ আমরা একে অন্যের রুচি, চিন্তা, পরামর্শের উপর নির্ভর করে থাকি। তাঁদের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে বলি (কারণ না বললে নিজেকে অপরাধী লাগছে), টলস্টয়ের অ্যানা ক্যারেনিনা তো অবশ্যই, তার সাথে উল্লিখিত দুটো বই পড়ার অনুরোধ তো থাকলই। কিন্তু কথাটা তা না।
আমি টলস্টয়ের সমসাময়িক আরেকজন লেখকের কথা না উল্লেখ করে পারছি না - দস্তয়েভস্কি। কিছুটা অবান্তর হলেও, এখানেই ওর উল্লেখ করলাম কারণ ওর তিনটে লেখা (CRIME AND PUNISHMENT, THE IDIOT, THE BROTHERS KARAMAZOVE) পড়ার পর আমি কিছুই লিখতে পারিনি। বিশেষ করে THE BROTHERS KARAMAZOV. বইটার আয়তন যথেষ্ট বড়। তবে শুধু এতটা বলা যেতে পারে, জীবনটাকে একবার নগ্ন, চোখাচোখি করতে গেলে এ বইটার কোনো তুলনা নেই। বইটার সম্বন্ধে কিছু বলতে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। যেন খুব অল্প একটা অংশই স্পর্শ করতে পেরেছি বলে মনে হয়। বইটার খুব ভালো ইংরাজী অনুবাদ করেছে ভিন্টেজ আর পেঙ্গুইন। এটা বলে রাখছি কারণ সময়ের অপচয় হবে না খারাপ অনুবাদ পড়ে। মজার কথা টলস্টয় তাঁর জীবনের শেষ পড়া বই বলতে এই শেষোক্ত বইটার কথাই পাওয়া যায়। বলেছিলেন, উন্মাদ না হলে এ লেখা লেখা যায় না। আর যথার্থ উন্মাদ না হলে সার্থক সৃষ্টিও হয় না।

Category