Skip to main content
 
 
 
বছরের প্রান্ত সীমানায় পৌঁছিয়ে হঠাৎ ভাগ্যের তোরণ গেল খুলে। হাতে এসে পড়ল যশোধরা রায়চৌধুরীর একগুচ্ছ কবিতার বই। কিভাবে এলো সে গল্প থাক। শব্দের ভিতরের শব্দদের কথায় আসা যাক। 
শুনেছি কবিতায় মিথ্যা কথা বলা যায় না। কথাটা যেন ঠিক তা না, কবিতা সত্য-মিথ্যা হিসাবের পারের কোনো কথা। সেখানে আটপৌরে সত্য-মিথ্যার হিসাব ধোপে টেকে না। যশোধরার ভাষায় - 'ফাঁপা সত্যকে জানার ক্লান্তি অপনোদনের জন্য, হাহা হিহি, হাসি/আপাতত এই মিথ্যে” (রাত্রি বিষয়ে আরো একটি)। 
যশোধরার লেখা নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার আছে কিনা এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। এক অর্থে না থাকলেও, আরেক অর্থে আছে। ভালোবাসা একটা যোগ্যতা দেয় নিজের ভালোলাগাটা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। আমি যখন কাউকে হিমালয়ের কিম্বা পুরীর সমুদ্র দেখার ভালো লাগাটাকে শেয়ার করি, তখন আমাকে পর্বত বা সমুদ্র বিশারদ হতে হয় না, শুধু নিজের ভালোলাগাটাকে অকৃত্রিম সৎ আর স্বচ্ছ রাখতে হয়। সে নিয়ে যেন কোনো সংশয় না থাকে। 
যশোধরার কবিতার মূল আকর্ষণ আমার কাছে ওর স্ফটিক স্বচ্ছতা, ভাবের, ভাষার আর বোধের।
 
 
      হয় আমি সত্যি কথা বলি
    নয় সেইসব মিথ্যে, যার জন্য খাক হয়ে আছি
   এছাড়া তৃতীয় নেই, অন্য কোনো ভেজাল পাবে না ...
 
ওর কবিতারা এমন ভাষায় মুখবন্ধ লেখে। একটা অঙ্গীকার করে। যে অঙ্গীকার পাঠককে দিয়েও করিয়ে নেয় পাঠকের অজান্তেই, যা অনুভব করব তা সত্যিই অনুভব করব, আঙ্গিকের কপট তর্ক ছলনার আড়ালে নিজের মানসিক স্থবিরতার আশ্রয় খুঁজব না। নড়তে না চাইলে কবিতাগুলো ধাক্কা, আর সরে জায়গা করে দিতে পারলে কবিতাগুলো যন্ত্রণা। যশোধরার কবিতারা শান্তি দেয় না। জ্বালা ধরায়, অসহ্য সব সত্যি কথাদের বে-আব্রু সামনে দাঁড় করায়।
 
 
     আমার ভিতরে তুমি প্রবেশাধিকার পাবে বলে
    আজ নিয়ে এসেছো শরীরধর্ম, বর্মহীন, খোলা
 
      সেই সুযোগেই জেনো শরীরে প্রবেশ করে পাপ
      সেই সুযোগেই এই হৃদয়েও মিথ্যা ঢুকে যায়
 
      
      দুজনেই নগ্ন আছি বলে
      অসম্ভব সাবধানে রয়েছি
আমাকে সামলিয়ে নিও তুমি, যদি ভুল হয়ে পড়ে
তোমাকেও যত্ন করে সামলে নেবো, যদি ঝরে যাও -
(চাওয়া দুই)
 
 
যশোধরার কবিতায় প্রেম যৌনতা কলকাতা সবাই পাশাপাশি হাঁটে। যৌনতারা অন্ধকারের পাতালবাসী না, অথবা আড়চোখে চেখে দেখা যৌনতারাও না। তারা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। তাদের দাবী ক্ষোভ অভিমান সব আছে। তুলোয় করে অনুপান খাওয়ান না যশোধরা পাঠককে, সরাসরি চোখের দিকে তাকান। 
 
    ...শরীরে শরীর লেগে না থাকলে সে তো দূরত্বই। কেন মেনে নেব?
       কেন খাটব? পয়সা রোজগার করব? কেন বা ঘুমব?
       যদি না জাগার মধ্যে টের পাই যুক্ত হয়ে আছি?
 
 
যুক্ত হয়ে থাকার নীরব এই লিপ্ততা, এখন
সকালের বিন্দু বিন্দু জেগে ওঠা আর রমণের পর ঘুম
সঙ্গে মিলেমিশে একটা পিণ্ড, ঘন আরক হয়েছে
 
 
আমাকে-তোমাকে সেই জেলিপদার্থের মধ্যে কেউ
আলাদা করুক দেখি? পারবে না কখনো
 
 
আলাদা শুচ্ছি যে, জেনো, এরও একটা সুরাহা রয়েছে...স্বপ্ন 
(রাত্রির কবিতা দুই)
 
কবিতারা যখন কথা বলে তখন গদ্যের চুপ করে থাকাই ভালো, না হলে প্রচুর কোলাহলের মত শোনায়। তবু আরো কিছু কথা তো বলতেই হবে শুরু যখন করেছি। যশোধরার কবিতায় প্রতিবাদ আছে। কি ভাষায়, কি কণ্ঠে সে প্রতিবাদ সেটা বড় অদ্ভুত। মেয়েদের কথাই যে শুধু আছে তা তো নয়, ট্যাক্সিওলা, চাওয়ালা সবার কথা আছে। ভায়োলেন্স তো অনেক রকম হয়। তার মধ্যে একটা বড় ভায়োলেন্স - উপেক্ষা, অবহেলা। যশোধরার কবিতায় ওরা এসেছে। অত্যাচার এসেছে। 'চিরন্তন গল্পমালায়' রীতা, সুধা, শম্পার কথা এসেছে। সব আত্মহত্যাই তো আত্মহত্যা নয়, উদ্যত ছুরিকে অনেকে প্রত্যাখান করে না, ভালোবাসায়।
 
 হাড় মাস থেকে তুমি প্রাণটিকে আলগা করে দিলে
    এত ভালোবাসা আমি জন্মেও ভাবিনি কখনো
    এখন কোথায় যাব? আমার তো দেহ নেই কোনো।
   আমি তবে উড়ে যাব, বেলুনের মত, শূন্যপথে? (প্রাণ)
 
         অথবা
 
 
   এ পিশাচিনীর মনে অন্য কোনো ভালোবাসা নেই
   এই আত্মরতি, ঘন, প্রিয়, যেন অপর মানুষ
  আরো আরো আরো প্রিয় হলে তবে মেনে নেওয়া যেত
  কে সেই মানুষ বলো, মেনে নেবে এত অত্যাচার
 
 
তাহলে সততা হত, তাহলে তো আত্মশুদ্ধি হত
স্পর্ধার এ লম্বা লম্বা শিখা, উঠে যেত উপরে, চূড়ায়
যদি ঐ অত্যাচারিতের মধ্যে কেউ, কোনো সরল, কিশোর
ধরে দিত মুণ্ড,কচি, পদার্থ, মধুর, শাবক
 
 
এই পিশাচিনী শুধু সৎ সেই শাবকপ্রেমিক চেয়েছিল
এ পিশাচিনীর জেনো মনে অন্য কোনো পাপ নেই।
(পিশাচিনী)
 
 
     শরীর বড় বাঙময় যশোধরার কবিতায়। ঠিক তা নয় অবশ্য। যশোধরা মানুষের সত্তাকে টুকরো টুকরো করে খোপে খোপে ভরে দেখান না। তাই পার্থিব জগতে স্বর্গীয় সুখের কথা বলতে সুর আসছে -
'বাইরে ইমন বাজছে, টাটকা ঋজু, ঘষে যাওয়া ছড়ের মতন, সুরে সুরে'
 
ওনার কবিতার ভাষা নিয়ে বলতে গেলে সে থামা দায় হবে। শুরুতেই বলেছিলাম ওনার ভাষার কথা। ইংরাজী, হিন্দী, চলতি সব শব্দরাই ধ্রুপদী শব্দের পাশাপাশি জায়গা করে নেয়। তার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে ছটিয়ে কবিতাগুলোতে। যশোধরা বুঝিয়ে দেন কোনো শব্দই ব্রাত্য নয় যদি তা অর্থের সাথে যায়, ভাবের সাথে যায়। কারণ অবশেষে সবই মানুষের ভাষা, মানুষেরই কথা বলে।
 
 
ফেসবুকের দেওয়াল খুব বড় একটা প্রশস্ত পরিসর নয় বড় লেখার। আর যশোধরার কবিতারা আমার মুঠোর মধ্যে যতটা এসেছে তার অতি স্বল্পমাত্রই লিখতে পারলাম। অনেক কিছু রয়ে গেল অধরা আর কিছু রয়ে গেল অপ্রকাশিত। থাক তাতে ক্ষতি নেই। যতটুকু বলতে চেষ্টা করলাম তাতেই মনের মধ্যের খুঁতখুঁতেমি গেল না, যেন ঠিক বলা হল না, আরো অনেক অনেক কিছু তো রয়ে গেলই অবশ্য বলার। 
শেষ করব ওনার লেখা আমার একটা প্রিয় কবিতার কিছু লাইন দিয়ে, তবে শেষের আগে কিছু কথা বলে নিই। জ্যোৎস্না রাতে যেমন ডোবার জলেও চাঁদের প্রতিচ্ছবি ভাসে, ঠিক তেমন আমার বন্ধুর তালিকাতেও ওনার প্রতিচ্ছবি আছে। জ্ঞানতৃষ্ণার অঙ্কুশে বিদ্ধ হয়ে বহুবার ওনার শরণাপন্ন হয়েছি, উনি ফেরাননি কখনো। সেই প্রশ্রয়ের জোরেই এই লেখা। যাঁদের যাঁদের কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই উনি একজন। তাই এ আমার শ্রদ্ধাঞ্জলিও বটে।
 
 
      ঈশ্বর আমার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু
      আমি চুর ঈশ্বরের প্রেমে
      দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা
      নেমে গিয়ে অপ্‌-মরুৎ-ব্যোমে
 
 
      ঈশ্বর আমার প্রেমে পড়েন যখনই
      আমি পড়ি ঈশ্বরের প্রেমে
      যে আমি নির্বাণ পাই একা একা, খেলে
      ঈশ্বরের পূণ্যস্নানে নেমে 
(ঈশ্বরের সাথে কথোপকথন)

 
 
 
(এই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। তাই নিলাম ওনার প্রোফাইল থেকে)

Category