Skip to main content

gandhi

 

ইংরেজিতে নামটা দেখে আমি উচ্চারণ করতাম, কার্ল জেস্পার। জার্মান-সুইস বিখ্যাত মনোবিদ তথা দার্শনিক। পরে শুনলাম, উচ্চারণ হবে কালা জেস্পাস। যা হোক উচ্চারণ, বানান নিয়ে আমার অত খুঁতখুঁতেমি নেই, ওতে মুখ্য ছেড়ে গৌণের দিকে ঝোঁক চলে যায় বেশি।

বিবিসি একটা তথ্যচিত্র বানায়, প্রাচীন আর আধুনিক যুগের তিনজন তিনজন করে প্রখ্যাত চিন্তাবিদদের উপর। প্রাচীন যুগে আসেন বুদ্ধ, সক্রেটিস আর কনফুসিয়াস। আধুনিক যুগে নীৎজে, ফ্রয়েড ও কার্ল মার্ক্স।

প্রাচীন যুগের ওই সময়টা পড়তে গিয়ে আমি একটা তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হই, 'অ্যাক্সিয়াল যুগ' বলে। এই ধারণার প্রবক্তা হলেন এই জেস্পাস মহাশয়। বেশ ইন্টেরেস্টিং লাগল তত্ত্বটা। ওঁর মতে পৃথিবীতে একটা নির্দিষ্ট যুগে মানুষের চিন্তার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছিল। মানুষের চিন্তায় মিস্টিসিজম্, পরাজাগতিক সত্য, অতীন্দ্রিয় সত্যের দিকে একটা ঝোঁক জন্মায়। ন্যায়নীতি নিয়েও ভাবনার ভিত্তি পরিবর্তন হয়। প্লেটোর গুহাতত্ত্ব, উপনিষদের ব্রহ্ম, বুদ্ধের পঞ্চস্কন্ধ ও চেতনার ভাবনা যা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী, জৈন দর্শন, কনফুসিয়াসের নীতিতত্ত্ব, খ্রীষ্ট, মুহম্মদ ইত্যাদি নানা ভাবনার একটা যুগ নিয়ে, এই অ্যাক্সিয়াল যুগ। আজ অবধি যত যত দর্শন, ধর্মের তত্ত্ব সব কিছুরই উদ্ভব ওই সময়টায়। আমাদের এই সময়ে জেস্পাসের এই অ্যাক্সিয়াল যুগ তত্ত্বটাকে নিয়ে ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর একটা দারুণ বই আছে 'দ্য গ্রেট ট্রান্সফরমেশন'।

=====

জেস্পাসের জীবনে যে ক'জন দার্শনিক ওঁকে প্রভাবিত করেছেন তাঁরা হলেন, স্পিনোজা, কান্ট, নীৎশে ও কিয়ের্কেগার্ড। জেস্পাসের দর্শনকেও অনেকে গভীরভাবে অস্তিত্ববাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যদিও উনি মানতেন না সে কথা। কিন্তু নিজের মত করে সত্যের অন্বেষণ কি মনোবিজ্ঞানে, কি দর্শনে ওঁর অবদান অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কিয়ের্কেগার্ড অনেকের মতে অস্তিত্ববাদের জনক। স্ব-অস্তিত্বের বোধ ছাড়া আসলে কোনো দর্শনই দাঁড়ায় না। কিন্তু, সেই স্ব-অস্তিত্বের বোধকে যিনি এক স্বাধীন দর্শনের জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন অবশ্যই কিয়ের্কেগার্ড। এখানে আরেকজনের নাম উল্লেখ করাও অবশ্যই আমার মতে উচিৎ, জে কৃষ্ণমূর্তি, যিনি স্ব-অস্তিত্ববোধের নিঃসঙ্গ, নির্মম নির্জনতায় সত্যকে অনুভবের রাস্তা দেখিয়েছিলেন এক অত্যন্ত অস্থির সময়ে। অল্প কিছু মানুষ সেদিন ওঁর গুরুত্ব বুঝেছিলেন, এখন অনেকেই অনুভব করছেন, আবার করে চর্চাও শুরু হচ্ছে।

=====

জেস্পাসের শেষ প্রবন্ধ মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধটা ইউনেস্কোর ডিজিটাল লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। সেখানে মহাত্মার অহিংস আন্দোলনকে তিনি আরেক দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি লিখছেন, "Gandhi's self-discipline is not without inner violence. But this violence against one's own self is not a free coming- to-oneself. Therefore it is that, whoever inflicts violence on oneself only causes subjugation of others. Subjugating others by means of moral pressure is an element of Gandhi's effectiveness."

গান্ধীর স্ব-ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে, নিজের উপর আরোপিত 'ভায়োলেন্স'-এর কথা যখন বলছেন জেস্পাস, তখন ভারতীয় অধ্যাত্মিক সাধনার সুপ্রাচীন ইতিহাসের কথাও উল্লেখ করছেন জেস্পাস। যেখানে এইভাবে আত্মপীড়নের সমর্থন আছে, অবশ্যই কিছুদূর অবধি। গীতাতেও যখন বলা হচ্ছে নিজেকে এইভাবে ইন্দ্রিয়সুখের থেকে বঞ্চিত করে মানুষ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আত্মার দর্শনের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে সে শুষ্কতা কেটে যায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে, ৫৯ নং শ্লোক বলেন, "Aspirants may restrain the senses from their objects of enjoyment, but the taste for the sense objects remains. However, even this taste ceases for those who realize the Supreme."

এ ভারতীয় প্রাচীন সাধনতত্ত্ব। বুদ্ধ এর চূড়ান্ত অবস্থা থেকে সরিয়ে মধ্যপন্থায় এসেছিলেন। এবং সে ঘটনাও উল্লেখ্য যে বুদ্ধ যখন মধ্যপন্থায় আসতে চান, তখন ওর সঙ্গীরা ভাবেন যে বুদ্ধ সাধনপথ ভ্রষ্ট, তাই তারা বুদ্ধকে ত্যাগ করেন। আমাদের আধুনিক যুগের সাধকদের মধ্যেও এই অত্যন্ত কঠোরভাবে ইন্দ্রিয়সংযমের ইতিহাস আছে। গীতার দর্শনও মধ্যপথানুগামী। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৬/১৭ নম্বর শ্লোক দেখলেই বোঝা যায়---

O Arjun, those who eat too much or too little, sleep too much or too little, cannot attain success in Yog. [16]

But those who are temperate in eating and recreation, balanced in work, and regulated in sleep, can mitigate all sorrows by practicing Yog. [17]

রবীন্দ্রনাথ এই আত্ম-অনুশাসনের রাস্তাকে স্বীকার করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, নরম ঘাসের নীচে কঠিন মাটি আছে বলেই সে ঘাসে হাঁটা সম্ভব। এ উপমাটা বেশ। 'শান্তিনিকেতন' প্রবন্ধগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শুধু দার্শনিক নন, সাধকও। তাই সাধনার কাঠিন্যের দিকটাও জানাচ্ছেন।

কিন্তু ভারতীয় সাধনায় আরো এমন দিক আছে যা আমাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মনের কাছে বড্ড কিম্ভুত শুধু না, দুরাচারসদৃশ্য। মহাত্মার যৌন সংযমের পরীক্ষা, যা অবশ্যই গোপনে না, বহু বিতর্কিত তাই। এমনকি একবার স্বপ্নদোষে বীর্যস্খলনের ঘটনাও প্রকাশ্যে হরিজনে লিখতে চেয়েছিলেন যাতে সবাই জানে তিনি ইন্দ্রিয় সংযমে দুর্বল। সুভাষের বেলপাতা খেয়ে খেয়ে কামসংযমের ঘটনাও জানা। আবার ওদিকে রামকৃষ্ণদেবের উলঙ্গ হয়ে উলঙ্গ যুবতীর কোলে বসে সাধনার অঙ্গও লিপিবদ্ধ। সেক্স নিয়ে একটা মারাত্মক অবসেসান ভারতীয় সাধনায় আছে। যা নিয়ে বিখ্যাত মনোবিদ সুধীর কক্করের অসামান্য গবেষণা আছে। যার মধ্যে রামকৃষ্ণদেবের যৌনতা নিয়েও কাজের একটা অধ্যায় আছে। অবশ্য কোনো কাজই নিন্দাত্মক, প্রশংসাত্মক নয়, কাজগুলো সবই সত্যের অন্বেষণ। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

=====

মহাত্মার সাধনার কথা ও যৌনজীবনের গুরুত্ব বৈবাহিক জীবনে আরেকটা চিঠিতে স্পষ্ট হয়। ১৯২২ সালের, মার্চের ১৭ তারিখ মণিলালকে লিখছেন---

"Now about your personal problem. Both Naidu and Ramdas tell me that I should write to you about your marriage. They believe that deep down in your heart there is the desire to marry, but that you would marry only if I absolve you from your promise. I do not consider you to be under any promise to me. It would be proper for every man to be under binding to himself. One is one’s own enemy or friend. You have bound yourself and you alone can free yourself from it.

It is my opinion that whatever peace you get is because of your self-imposed binding. You can be sure about this. As long as you do not think of marriage, you stand absolved from your past sins. This atonement of yours keeps you pure. You can stand up as a man before the world. The day you marry you will lose your lustre. Take it from me that there is no happiness in marriage. To the extent Ba is my friend, I derive happiness from her, no doubt. But I derive the same happiness from all of you and from the many men and women who love and serve me. I derive more [happiness] from the man or woman who understands me. If, at this moment, I get enamored of Ba and indulge in sexual gratification, I would fall the very instant. My work would go to the dogs and I would lose in a twinkling all that power which would enable one to achieve swaraj. My relation with Ba today is that of brother and sister, and the fame I have is due to it.

Please do not think that I got this wisdom after I had my fill of pleasure. I am simply painting before you the world as I find it from experience. I cannot imagine a thing as ugly as the intercourse of man and woman. That it leads to the birth of children is due to God’s inscrutable way. But I do not at all believe that procreation is a duty or that the world will come to grief without it. Suppose for a moment that all procreation stops, it will only mean that all destruction will cease.

Moksha is nothing but release from the cycle of births and deaths.

This alone is believed to be the highest bliss, and rightly.

I see every day that all our physical enjoyments, without exception, are unclean. We take this very uncleanliness to be hap-piness. Such is the mysterious way of God. However, our purushartha lies in getting out of this delusion.

Having said all this, I regard you as quite free [to act as you please]. I have written this merely as a friend. I have not given any command as a father. “Be you good” this is my only injunction.

However, do what you wish, but not what I wish. If you simply cannot do without marrying, do think of marriage by all means. Please write to me in detail what your innermost thoughts are."

এখানে আরেকটা দিক উল্লেখ্য, বাবা হয়ে ১৯২২ সালে নিজের ও নিজের স্ত্রী'র যৌন জীবন নিয়ে এত স্পষ্ট করে বলতে পারার ক্ষমতাটাও আশ্চর্যের নয় কি? আজও যেখানে ভারতে যৌনশিক্ষা বলে কোনো শিক্ষার প্রবর্তন প্রাথমিক স্কুলশিক্ষায় সঠিক মাত্রায় আনা সম্ভব হয়নি, আজও যেখানে শিক্ষক থেকে অভিভাবকেরা, বিশেষ করে পুত্রসন্তানের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন, সেখানে অতদিন আগে এসব কথা স্পষ্ট তখনই বলা সম্ভব যখন তার একটা স্বচ্ছ ধারণা বক্তার মধ্যে আছে।

এক্ষেত্রে বাঙালি বাবা-মায়ের সন্তানের উপর স্নেহ-আসক্তি অনেকটা অসুস্থতার পর্যায়ে গিয়ে পড়ে, এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাদের সন্তানের যে যৌনজীবন বলে কিছু থাকতে পারে…. "বাবু আমার ওসব কিচ্ছু বোঝে না".... "মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায় না"..... এ কথা বিয়ের আগের দিন অবধি চলে… কোনো কোন ক্ষেত্রে তাও ছাপিয়ে যায়। সেখানে এত স্পষ্ট করে আলোচনার আদর্শ একটা মৌলিক উদাহরণ অবশ্যই।

মহাত্মার এই কাঠিন্য তার বোধবুদ্ধির যে সর্বগ্রাসী নয়, তার একটা মজার উদাহরণ নেওয়া যাক---

সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের সঙ্গে তার ছেলে ঘনি খানের চুড়ান্ত মতবিরোধ চলছে। ঘনি খান তখন শান্তিনিকেতনে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও শিল্পকলায় মন দিতে চান। কিন্তু সীমান্ত গান্ধী চান না ছেলে সেদিকে যাক। বরং অন্যভাবে সে দেশসেবায় নিযুক্ত হোক। মহাত্মার কাছে মধ্যস্থতায় বাপ-ছেলে গেলেন। মহাত্মা দু'পক্ষকে শুনলেন। তারপর বললেন, ঈশ্বর যখন ওকে শিল্পকলার ক্ষমতায় ভূষিত করেছেন, তখন সে সেই নিয়েই থাকুক না কেন। নন্দলালের কাছে শিখুক। তাকে আর অন্যদিকে টানাটানি কেন।

বলা বাহুল্য, সীমান্ত গান্ধী মেনে নেন এবং ঘনি খান ভবিষ্যতে দার্শনিক, কবি ও স্থাপত্যকার হিসাবে যথেষ্ট বিখ্যাত হন।

=====

মহাত্মার স্ব-ইন্দ্রিয় পীড়নের আরেকটা উদাহরণ হল অনশন। এতদিনের টানা অনশনের ইতিহাস হয়তো খুব কম নেতার জীবনেই আছে। এর মূলেও সেই আত্ম-অনুশাসনের প্রবল চেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটাকে মজার ঘটনা হিসাবে দেখাই শ্রেয়।

ওশো'র সঙ্গে একবার আম্বেদকরের দেখা হয়। যে দলিত আইন নিয়ে মহাত্মার সঙ্গে অম্বেদকরের মতপার্থক্য হয় ও মহাত্মা অনশন শুরু করেন সে নিয়েও কথা হয়। আম্বেদকরকে বলেন ওশো, আপনি আন্দোলন তুলে নিলেন কেন? আম্বেদকর বলেন, আরে যদি মহাত্মার কিছু হয়ে যেত তখন সারা বিশ্ব আমাদের দায়ী করত।

কথাটা সত্য। মহাত্মার তখন বয়েস হয়েছে শুধু না, এই অনশনে শারীরিক ভাঙনও যথেষ্ট শুরু হয়েছিল। তো ওশো ঠাট্টা করে বলেন, তা আপনি মশায় পাশে একটা মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে অনশন শুরু করে দেননি কেন?

ঘটনাটা মজার অবশ্যই। কিন্তু কথাটা তো তাই। মহাত্মার অনশন ততদিনে এক অভ্যাসে পরিণত। শরীর যতটা চাপ নিতে সক্ষম ছিল সে তো অভ্যাসেরই ফল। জেস্পাসের মতে যা নিজের উপর ভায়োলেন্স।

=====

সেই জেস্পাস তার প্রবন্ধ শেষ করছেন এই বলে যে, "Gandhi has become the unique example in our day of the religious politics of a self-revealing man. A man who was humiliated in South Africa because of his race, who was inspired by his Indian origin and educated in English, is driven by a love for a free India which would regain its res- pectability, driven as well by a readiness for suffering and for unlimited sacrifice, thereby permanently stalling a sense of guilt which goads on to new determination.

Today we face the question: How can we emerge from physical power, and wars, so that we do not all perish under atom bombs? Gandhi provided the true answer through deed and word: only from higher politics comes the strength that would rescue us from our political crises. It is inspiring that this answer is provided in our times by an Asian."

আমি শেষ কর‍তে চাই রবীন্দ্রনাথের ভাষণের একটা অংশ দিয়ে….

"Today in our determined effort let us join Mahatmaji in his noble task of removing the burden of ages, the burden of disrespect upon the bent back of those who have been stigmatized for the accident of their birth, and the sin of wilful denial, to a large body of our countrymen, of sympathy which is the birth-right of all human beings. We are not only casting off the chain of India's moral enslavement but indicating the path for all humanity. We are challenging the victimization, wherever and in whatever form it may exist, to stand the test of relentless questioning of the conscience which Mahatmaji has brought to bear upon our day.

When Mahatmaji began his penance there were cynics in our own country and abroad who mocked and jeered at him, and yet before our very eyes the wonder has happened. Hard rocks of tradition have been blasted. Irrational prohibitions, cramping our national life, are already showing signs of tottering. Great has been the achievement due to his penance, but it will be a greater glory to him and to us if we can fulfil his vow by fighting to a finish the evils of untouchability, of intolerance, of all that hinders the comradeship of man and man and obstructs our path to freedom and righteousness.

My friends, I appeal to you, do not betray your Great Man and your own humanity by any deviation of your initiative from the pursuit of justice and love towards your fellowmen who have suffered humiliation for ages and remained dumb in a pathetic apathy of resignation, never even blaming Providence and their own cruel destiny. But the angry voice has at last come from the Divine Guide of our history with its warning message that they cut at the root of freedom who, in their unreasoning pride, obstruct the freedom of social communication among their own kindreds."