মহাপ্রভু বললেন, কি চাই জানো? প্রেম। ভালোবাসা। অহংকারের মেঘ যদি সরে গেল, অমনি দেখো, ভালোবাসার চাঁদ উঁকি দিল। তোমায় শান্ত করবে, শীতল করে আনন্দিত করবে, পূর্ণ করবে।
কিন্তু কাকে ভালোবাসবো?
মহাপ্রভু বলছেন, প্রশ্নটাই তো ভুল করছ। ভালোবাসা হও। নিজেই ভালোবাসা হও। ভালোবাসা কোনো প্রতিক্রিয়া নয়, যেন খাবার, সামনে এলেই জিভে জল এলো। ভালোবাসা একটা অবস্থান। ভালোবাসা চেতনা। চেতনা আকাশ। আকাশ ঢেকেছে অহংকারের মেঘে। সরাও।
কিভাবে সরাবো?
ডাকো। ডাকলেই হবে। শোনোনি, আমি লিখেছি, 'চেতো-দর্পণ-মার্জনং'… ডাকলেই তোমার চেতনার দর্পণ স্বচ্ছ হবে। জীবনকে অকারণে ঘোলাটে করে লাভ কি বলো? সারাজীবন কি শুধু ভালোবাসার ধারণা নিয়ে বাঁচবে, ভালোবাসার কল্পনাকে ভালোবেসে যাবে? আজীবন কি ঘোলাটে জীবনে অস্বচ্ছতাকে সুখ বলে আঁকড়ে থাকবে? সব সুখ কি শুধু ভবিষ্যতে হবে বলে নিজেকে ঠকাবে?
আমার যে ভীষণ জ্বালা... কষ্ট... যন্ত্রণা... অভাব...
মহাপ্রভু বললেন, আমি যে লিখেছি, 'ভব-মহা-দাবাগ্নি-নির্বাপণং'… আমি কি জানি না সংসারে জ্বালা… আমার কাছ থেকে কি লুকাবে? তোমার জ্বালা তো আরো জ্বালা বাড়িয়ে জুড়াবে না… তোমার ভিতরে তোমার এক পরম বান্ধব আছে… তোমার বধূ… বিদ্যাবধূ… সে বিদ্যা.. সে স্বচ্ছবোধ… তাকে ডাকো… তার দিকে তাকাও… নিজেকে চেনো তার চোখে… বাইরের দিকে তাকিয়ে না.. বাইরের যা কিছু তাকে সেই বধূর সামনে আনো… সে যাকে রাখে তা-ই রাখো… সে যাকে চায় না তাকে তুমিও চেয়ো না…. আমি লিখেছি… 'বিদ্যা-বধূ-জীবনম'…. তোমার আকুল ডাকে কাটবে মেঘ… চাঁদের আলো পড়বে সেই বধূর আননে… বিদ্যাময় সে মুখ.. তোমার সুখ… তোমার আনন্দ… তোমার পরিপূর্ণতা….
আমার জ্ঞান.. আমার পাণ্ডিত্য.. আমার স্বপ্ন.. আমার বাসনা… আমার পরিবার পরিজন… বন্ধুবান্ধব….
মহাপ্রভু হেসে বললেন, দাস হও… কাউকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়ো না… কারোর নিয়ন্ত্রণে থাকার যোগ্যতা তুমি হারাবে… সহ্য করো… সহ্য করা মানে নিরুপায় হওয়া নয়.. সহ্য করা মানে সময়কে সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া.. নিজের অভিমানে সময়ের চাবুকে নিজেকে কষাঘাত করা না… যা কিছু ঘটে সময়ের চাকায় ঘটে… সময়ের উপর কেউ বলবতী নয়… অভিমান বোঝে না… বিদ্যাবধূ জানে…
রথের রশি কি আমারও তবে?
রশিটা তোমারও… শুধু নিজের দিকে টেনো না… চাপা পড়ে শেষ হবে… সামনের দিকে টানো… যেদিকে পথ সেদিকে টানো… যত এগোবে তত জানবে তুমি চিরটাকাল রথের রশি নিয়ে এগিয়ে চলেছ…. বাধা এসেছে যুগে যুগে… রথ থমকেছে…. কিন্তু আবার চলেছে…. সমাজে এক-এক সময় আসে.. মানুষ যখন বিভ্রান্ত হয়… রথের রশির টান দশদিকে দশরকম হয়… রথ এগোয় না… যিনি লীলাময়, তিনি সাক্ষীস্বরূপ হন… ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া…এ আসুরীবল… জগন্নাথের লীলা নয়… যেখানে মিল… সেখানেই সুর… সেখানেই বাঁশি…সেখানেই প্রভুর লীলা….
আমি এলাম তবে…
মহাপ্রভু বললেন, এগোও… যে আসে তাকে নিয়ে এগোও… যে আসতে চায় না, তাকেও ডাকো…. মানুষ ডাকতে ভুলে যায় বলেই দরজায় মরচে ধরে… তাড়িয়ে নিয়ে জোর করে যে চালাতে চায়… তাকে অসুর জেনো… যে ডাকতে জানে… সে-ই মানুষ…. আমি তো ডাকতে শেখানোর জন্যেই এসেছি… ডাকো…ডাকো… হৃদয় খুলে ডাকো… আঘাত পাও…আঘাত কোরো না… মঙ্গলের চাকা গড়াক… বুক পেতে দাও…. ডাকো… ডাকো… ডাকো….
[ছবি - Suman Das]