শিমুল দুশোটা কবিতার বই ছাপিয়েছিল। বইমেলার শেষে দেখল বিক্রি হয়েছে আটত্রিশটা। এক এক বইতে তিরিশটা কবিতা। একদম সাধারণ ছাপা। পুরুলিয়াতেই। বন্ধুর ছাপাখানা। অল্পেই করে দিয়েছে।
শিমুল প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস। বউ, পর্ণাও আসে প্রতি বছর। দুজনেই সারা মেলায় হেঁটে হেঁটে বই বিক্রি করে। বই কেনে। একদিন কি দুদিন একটু ভালো খাবার কেনে, খায়। এবারে কিচ্ছু হল না। পর্ণার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ল। কেমো শুরু হয়েছে। পর্ণার শরীরটা বদলে যাচ্ছে। পর্ণাও।
বাড়ি ফিরে গেলেও হত। ইচ্ছা করল না। শিমুল আবার মেলার মাঠে এলো। স্টল ভেঙে দিচ্ছে একে একে। তার বইগুলো আজও কাঁধের ব্যাগে। এইটা নিয়ে তার এগারো নম্বর বই।
পর্ণার ফোন।
খেয়েছ?
হ্যাঁ, তুমি?
এই খেলাম। আজ ফিরছ?
হ্যাঁ আজই।
এখন নিশ্চয়ই মেলায়। মন খারাপ।
শিমুল কথা বাড়ালো না বেশি। গ্রামের বাড়িটার কথা ভাবছে। ফেলে আসা জীবনটার কথা ভাবছে। এত ভুল এত ভুল! যদি গোটা মন দিয়ে সংসার করত? যদি অনেক টাকা জমাতো? এখন অনেক টাকার দরকার। পর্ণার চিকিৎসায় লাগবে। পর্ণা চলে যাবে? থাকবে না?
=======
পর্ণার এই ছবিটা ভিক্টোরিয়ার সামনে তোলা। চন্দন মাখানো। বড় বউদি সাজালো। আজ শ্রাদ্ধ। বইমেলা শুরু হয়ে গেছে। এ বছর নতুন বই নেই। পুরোনো বইগুলো নিয়েই শিমুল যাবে মেলায়।
======
বইমেলায় প্রচণ্ড ভিড়। শেষ শনিবার। সকাল থেকে কিছু খায়নি শিমুল। ইচ্ছা করেনি। একটু জটলা দেখলে, সামনে দাঁড়িয়েছে, বই কিনতে বলেনি এবারে, ডায়েরি খুলে কবিতা শুনিয়েছে। এই কবিতাগুলো সব পর্ণার শেষের কদিনে লেখা। মাথার কাছে বসে। টয়লেটের বাইরে পর্ণার জন্য অপেক্ষায়। হাসপাতালের সিঁড়িতে বসে। রাতে ছাদে বসে, মোবাইলে লিখেছে। নীচ থেকে গোঙাচ্ছে পর্ণা। জানলার ধারে খাট তো। ডায়েরিটার নাম দিয়েছে গোঙানি। সেই ডায়েরির পাতা থেকে কবিতা শোনাচ্ছে।
একজন কি দু’জন শুনছে। কিন্তু কেউ না শুনলেই ভালো লাগছে, কেউ শুনলে, কারোর চোখেমুখে কবিতার ব্যথাটা ফুটে উঠলে, গলার কাছে শ্বাস আটকিয়ে কান্না জমে আসছে। যেন গুঁড়ো দুধের দলা আটকিয়েছে গলায়। হল তো কয়েকবার। কবিতা সম্পূর্ণ না করেই পালিয়ে এসেছে। ভিড়ে কাঁদা যায় নাকি?
তবু বিক্রি হল বই। চোদ্দোটা। খুব অল্প দামে বিক্রি করে দিল। আর তো আসবে না বইমেলা। কবিতা লিখবে। এরপর লিখবে উদাসীন কবিতাগুচ্ছ। মৃত্যু অবশেষে উদাসীন করে। যত গভীর ভালোবাসার শিকড়, মৃত্যুর পরে তত অভিযোগহীন মানুষ। তত অভিযোগহীন উদাসীনতা। উদাসীন কবিতা কত টাকায় বিক্রি করবে? থাক, তার চাইতে একা একা পড়বে। বইমেলা শেষ হলে, কোনো মানুষ যদি উদাসীন বসে থাকে মাঠে এসে, তাকে শোনাবে। যদি না শুনতে চায়, তার কথা শুনবে।
========
বাস থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে শিমুল। বসন্তকালের গরমে পুড়ছে মাটি, গাছ, পুকুর। শিমুল, পলাশে ভরে আছে গাছ। তাদের এই গ্রামটার নাম টুরিস্ট লিস্টে নেই, তাই শহুরেদের ভিড়ও নেই।
একটা পুকুরের ধারে দাঁড়ালো শিমুল। পলাশের ছায়া পড়েছে জলে। টলটল করছে। কতগুলো পানকৌড়ি জলে নেমে আসা একটা ডালের উপর বসে। শিমুল বসে পড়ল। শীতঘুম ছেড়ে গ্রীষ্মে জাগছে জগতসংসার। শিমুল আর ঘুমাবে না। অপেক্ষা করবে সে উদাসীনতার কবিতাগুচ্ছের। আসবেই, জানে শিমুল। শিমুল পর্ণাকে ধারণ করবে। পর্ণা আর তার আদরে জন্মাবে কবিতাগুচ্ছ। উদাসীন। তারা এ পৃথিবীর কবিতা না। পর্ণা যেখানে গেছে, সে পৃথিবীরও না। তারা তৈরি করবে তাদের পৃথিবী, যেখানে শিমুলের ছায়া সবুজ পুকুরের জলে পড়ে, অপেক্ষা করবে পূর্ণিমার চাঁদের। সাদা বক হয়ে উড়ে যাবে পর্ণা আর সে, পালকের মত নরম কবিতাদের ছড়িয়ে দিয়ে, এই প্রেমহীন, ধৈর্যহীন মানুষগুলোর জন্য।