অনেক রাত। চাঁদ পূর্ণিমা ছেড়ে অল্প অল্প ক্ষীণ হচ্ছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাশে গঙ্গা বইছে কুলকুল করে। স্কাইওয়াকের ছাদে পড়েছে চাঁদের আলো। পাশের রেললাইন দিয়ে ঝমঝম করে মালগাড়ি চলে গেল একটা।
একজন মানুষ বাইক এনে রাখল মন্দিরের বাইরে। তার হাঁটাচলা দেখে মনে হচ্ছে মরিয়া হয়েই এসেছে কিছু নিয়ে একটা। সে এসে দাঁড়াতেই বড় ফটক খুলে গেল। রামকৃষ্ণদেবের ঘরের দিকে এগোচ্ছে। অনেকদিন পর এলো। সামনে রাসমণির মূর্তি, তাকালো একবার।
রামকৃষ্ণদেবের ঘরের সামনে এসে বসল বারান্দায়। ঘর বন্ধ। একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল কোথাও।
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ঠাকুর… রক্ষা করো… রক্ষা করো..
বাতাসে ভেসে আসল যুগান্তরের কণ্ঠ… কেন রে?
সে বলল, আর যে পারছি না… ছোটোখাটো বিজনেস আমার.. মানে ব্যবসা… সামনে কালীপুজো… আবার সেই…
বাতাসে ভেসে আসা বিস্মিত গলা... আবার সেই মানে?
মানে চাঁদা ঠাকুর… কেউ যে হাজারের নীচে নামে না গো….! চোখ রাঙানি… রাস্তাঘাটে লরি আটকানো… আবার সেই… হ্যাঁ গো ঠাকুর…. তুমি একটু মাকে বলে দিলে হবে না?
বাতাসে দীর্ঘশ্বাস… তারপর বাক্য... তুই এই নিয়ে একশো তিপান্ন নম্বর… শুনেছি রামপ্রসাদ… বামাক্ষ্যাপা সবার কাছেই লোকে যাচ্ছে…. কাঁদছে…. কিন্তু আমরা তো এরকম চাঁদাগ্রাসী ভক্তি শেখাইনি রে বাপু… সে তুই রামপ্রসাদের গানগুলোই নে না কেন… সে তো অত মায়ের নাম প্রচার করল… মায়ের ভক্তি তহবিলের কথা বলল.. চাঁদার তহবিলের কথা তো বলেনি রে…
সে বলল, তবে ঠাকুর… কি হবে?
আবার দীর্ঘশ্বাস…. কি আর হবে রে…. আমি মা-কে জিজ্ঞাসা করে দেখি… তুই কাল আয়….
সে পরের দিন আবার গেল। বারান্দায় বসেছে। কয়েকবার ডাকল। কেউ শুনছে না কথা। বাতাস চুপ। চারদিক ভীষণ নিস্তব্ধ।
সে উঠে বেরোতে যাবে, বাতাসে ভেসে এলো… কাশীপুর শ্মশানে যা…..
সে বাইক চালিয়ে এলো। শ্মশানের বাইরে বসল। বলল, মা কি বললেন ঠাকুর...?
বাতাসে শব্দ ভেসে এলো, কুরুক্ষেত্র আর বৃন্দাবনের যা পার্থক্য… সে পার্থক্য বোঝো…. ভক্ত যা স্বেচ্ছায় আনন্দে দেয়, তা নৈবেদ্য… আর ভক্তের কাছ থেকে যা নেওয়া হয়, ভয়ে, কৌশলে, উস্কানিতে.. সে লোভের… তা দিয়ে পুজো হয় না… মোচ্ছব হয়…
সে বলল, তবে কি হবে আমাদের?
বাতাস বলল, চেতনা যতক্ষণ না হচ্ছে এই কাড়াকাড়ি চলবে….
সব যে লোপাট হবে…
উত্তর নেই। হোয়াটস অ্যাপে মেসেজের পর মেসেজ… চাঁদার হিসাব…. অনেকগুলো মিসড কল.. ক্লাবের সব….
সে উঠল। শ্মশানকে পিছনে রেখে দাঁড়ালো। পালিয়ে যাবে? কিন্তু কদ্দিন? বাইকে স্টার্ট দিল। রামকৃষ্ণদেব চাঁদা দেননি। বামাক্ষ্যাপা চাঁদা দেননি। রামপ্রসাদ চাঁদা দেননি।
কি সত্য তবে? চাঁদা না ধর্ম? ভয় না ভক্তি? ত্রাস না শান্তি? ঈশ্বর না উৎসব? পালানো না মেনে নেওয়া?
উত্তর নেই। বাইক ছুটছে মধ্যরাতে কলকাতার রাস্তা চিরে। প্রশ্নেরা ভিড় করে তাকিয়ে, কেউ উত্তর পায়নি। পাবেও না কেউ কোনোদিন। উত্তরটা জানা নেই বলেই।