সৌরভ ভট্টাচার্য
9 April 2020
চার দিন হলো গরমটা একই রকম ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্যৈষ্ঠমাস, গ্রামের বয়স্করা বলছে এরকম গরম নাকি গত পনেরো বছরেও পড়েনি। আর বলছে তারা, এই গরমটা আরো দশ-বারো দিন থাকবে। একে ন’তপা বলে। ন’দিন গরম কমবে না। তবে এবারের গরম আগের বারের মতো নয়। গাছের পাতাগুলো ঝলসে গেছে, চাষের ক্ষেতে বুড়ো মানুষের চামড়ার মত ফাটল, দীঘি-পুকুর সব শুকিয়ে এসেছে প্রায়। কুকুর-গরুগুলো ধুঁকছে। গ্রামের পণ্ডিতেরা বলছে নাকি মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়েছেন। হওয়ারই কথা, কারণটাও বলেছে, এবারের শিবরাত্রিতে শিবমন্দিরের পাশের বাড়ির পালেদের বউ জল শিবের মাথায় ঢালতে ঢালতে বুঝতে পারে যে সে রজঃস্বলা হয়ে পড়ছে কিন্তু তার এমন জেদ যে পুরো ঘটির জলটাই শিবের মাথায় ঢেলে তবে থামে। পালের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল। তার বউ প্রতিবারের শিবরাত্রিতে উপোস করে থাকে। গাঁয়ের মোড়ল ছিল তার শ্বশুর। টাকা পয়সার অভাব নেই, যথেষ্ট জমিজমাও আছে। কিন্তু কোল খালি। বংশে প্রদীপ দেবে কে? মহাদেবই ভরসা, তিনিই কোল ভরে দেবেন। সেদিন সকাল অবধি যখন কিছু হয়নি, পালেদের বউ ভেবেছিল বাবা বুঝি মুখ তুলে চেয়েছেন, কারণ সময় তো পেরিয়ে গেছে হপ্তা হল। কিন্তু বাবা শুনলেন কই? মন্দিরের মধ্যে দাঁড়িয়েই মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে, তারপর বাবার মাথায় জল ঢালতে ঢালতেই... থামেনি, ইচ্ছা করেই থামেনি। মনে হল বাবা নয়, পাথর, সে আর কি বুঝবে প্রাণের মায়া, মিথ্যা সব। কিন্তু কি করে কি করে খবরটা জানাজানি হয়ে গেল।
শিবমন্দিরটা এমন কিছু বড় না। চারদিকে সবুজ গ্রীল দেওয়া। বাঁধানো চাতাল, শিবলিঙ্গটা অনেক পুরোনো, মন্দিরটা নয়। এই দুপুরবেলা এদিকে কেউ বড় একটা আসে না, তাছাড়া যা রোদ্দুরের তাপ, কে বেরোবে বাড়ি থেকে? চারদিকটা তাই ফাঁকা ফাঁকাই। গ্রীলগুলো তেঁতে আছে, না ধরলেও বোঝা যাচ্ছে, যেন সবুজ রঙটা লাল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মন্দিরের সামনে দুটো ছাগল শুয়ে। মন্দিরের ডানদিকে পালেদের বাড়ি। বাঁ-দিকে পায়ে চলা রাস্তা। রাস্তার উপরেই শুয়ে ঘোষেদের দুটো গরু। তার ওপারে ফাঁকা চণ্ডীমণ্ডপ। মন্দিরের পিছনে একটা ঝোপ, ঝোপের মধ্যে পাঁচটা শুয়োর, ঝোপের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিনটে কুকুর – শ্রান্ত, কাহিল। ঝোপের মধ্যে একটা জলা ছিল, শুকিয়ে গেছে। প্রাণীগুলোকে দেখলে মনে হবে যেন মরে পড়ে আছে, শুধু ভাগাড়ে ফেলার অপেক্ষা।
শিবলিঙ্গের উপর থেকে নেমে আসা একটা কালো পিঁপড়ের সারি শিবলিঙ্গের সামনে রাখা ছোট্ট কাঁসার থালার উপরে রাখা হলুদ বাতাসার তিনভাগ খেয়ে ফেলেছে। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে মন্দিরের ঈশান কোনের লাল মেঝের ফাটল থেকে পিঁপড়ের সারি বেরিয়ে শিবলিঙ্গের পিছন থেকে ওপরে চড়ে শিবলিঙ্গের সামনে থেকে নেমে এসে বাতাসা শিকার করে আবার শিবলিঙ্গের সামনে থেকে চড়ে শিবলিঙ্গের পিছন থেকে নেমে মন্দিরের ঈশান কোনের ফাটলে ঢুকে যাচ্ছে। ফাটল সারানোর টাকা মঞ্জুর হয়েছিল পঞ্চায়েত থেকে। কিন্তু সে টাকার অর্ধেক মন্দির রং করতে আর বাকি অর্ধেক পালেদের তুলসী মঞ্চ তৈরি করতে খরচ হয়ে গেছে। গ্রামের লোক বলেছে তুলসী মঞ্চ তৈরিতে পাপ নেই। ওটা চুরি নয়, পুণ্যির কাজ।
পিঁপড়ের দলের সর্দার যে মোটা ডেঁও পিঁপড়েটা সে চায় না ঈশান কোনের ফাটলটা বন্ধ হোক। তার কত যুগের সংসার এই মন্দিরের তলদেশে। আগে একটা বাস্তুসাপ থাকত। তাদের পরিবারের অনেক সদস্যকে খেয়ে ফেলেছে। তারপর একদিন একটা লরি চাপা পড়ে মরে গেছে হাইরোডে। শুনেছে, দেখতে যাওয়া হয়নি।
সর্দার পিঁপড়ের বাতাসার কণা মুখে নিয়ে ফিরতে ফিরতে শিবলিঙ্গের মাথায় তার বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে দেখা, কি মনে হলো বাতাসার টুকরোটা তার মুখে দিয়ে শিবলিঙ্গের যে দিক দিয়ে কেউ নামে না, মানে তার চোদ্দোপুরুষ কেউ নামেনি সে দিক দিয়ে নেমে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে মন্দিরের বাইরে এসে ছোট্ট লাল চাতালটা পেরিয়ে পালেদের তুলসী মঞ্চটায় এসে উঠলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো মঞ্চটায় কোনো গর্ত হয়নি, অন্য কোনো পিঁপড়ের পরিবারও আসেনি। তুলসী মঞ্চ দিয়ে নামতে নামতে যদিও ভাবছিল সে শিবলিঙ্গ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, কিন্তু একটা গন্ধ পালেদের বাড়ির দিকে টানলো তাকে।
পালেদের বাইরের লাল তিনটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে, লাল বারান্দায় রাখা জুতোগুলোর পাশ দিয়ে গিয়ে, ডান দিকে বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ঢুকে, পালের ছেলে আর ছেলের বউকে গরমে প্যাঁচপ্যাঁচে ঘামে মৈথুনরত অবস্থায় আড়চোখে দেখে পাশের ঘরে খাটে আলুথালু হয়ে শুয়ে থাকা, বিরাশি বছরের পালগিন্নির খাটে গিয়ে উঠল। গন্ধটা জর্দার। ঘুমন্ত পালগিন্নির গাল বেয়ে পানের কষ গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা নীল বালিশের ওয়াড়ে, যে বালিশে পালমশাই মাথা রেখে দু’বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল ভোর রাতে। পালগিন্নির গালের উপর উঠে জর্দার গন্ধ মাখা কষ অল্প একটু চেটে দেখল পিঁপড়েটা। খুব ভালো লাগল না, তবে গন্ধটায় একটা মাদকতা আছে। পালগিন্নির ঘুমন্ত ডান হাতের সোনার আংটিপরা মধ্যমা আর সাদা চুন লাগা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আচমকা চিমটের মতো চেপে পিঁপড়েটাকে মেঝেতে ফেলে দিল। পিঁপড়েটা তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালো। ভাগ্যে আলনার নিচে চলে গিয়েছিল তাই পদপিষ্ট হয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তির সম্ভবনা রইল না।
একুশ দিন অজ্ঞান থাকার পরে একদিন দুপুরে ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় তার জ্ঞান ফিরল। আলনার নীচ থেকে বেরিয়ে দেখে বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুর্বল ক্লান্ত শরীরে দেওয়াল বেয়ে বেয়ে পাঁচটা শিক লাগানো জানলায় উঠে এসে দাঁড়ালো। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। পালেদের বাড়ির ছাদ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ে সারা মেঝে ভিজে গেছে। শিবমন্দিরের চাতাল অবধি জলে ডুবে গেছে। পিঁপড়েটা খাবার খুঁজল। ভিজে জানলার একটা দিকে বেগুনি রঙের একটা ছত্রাক হয়ে আছে। একটু ভেঙে মুখে দিয়ে দেখলো সুস্বাদু ছত্রাক। আড়চোখে দেখল পালগিন্নি মশারির মতন ত্রিপল খাটিয়ে চৌকিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে হলো পালের ছেলে আর ছেলের বউ এখনও মৈথুনরত। আওয়াজ আসছে।
বৃষ্টি থামার নাম নেই আজ চারদিন হল। জল উঠেছে শিবলিঙ্গের মাথা অবধি। রাস্তার ওদিকে চন্ডীমন্ডপ। গ্রামের সবক’টা গরু চন্ডীমন্ডপে বাঁধা। মনে হচ্ছে একটা প্রলয় হবে। পালগিন্নির খাটটা জলে ভাসছে, ঘরময় জল, প্রায় একটা মানুষের গলা অবধি। পালগিন্নি জর্দামুখে ঘুমন্ত অবস্থায় সারা ঘর ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে গলা জলে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরে পালের ছেলে আর তার বউ এখনও মৈথুনরত। শব্দ আসছে।
বৃষ্টি থামলো না, উপরন্তু বাড়লো। শিবমন্দিরটা ডুবে গেল চোখের সামনে দেখতে দেখতে। তার সমস্ত পরিবারটা ভেসে গেলো, পাল পরিবারের মত। পালগিন্নি, তার ছেলে আর তার ছেলের বউ ভাসতে ভাসতে এতক্ষণে সমুদ্রে চলে গেছে। সমস্ত গরু-ছাগল ভেসে যাচ্ছে। গ্রামের বাইরে একটা কবরস্থান আছে। সেইখান থেকে মড়াগুলো ভেসে ভেসে শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে চলে গেল। সবাই সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। পুরো গ্রামটাই ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে।
পিঁপড়েটা এ সব দেখছে পালেদের বাড়ির কার্ণিশে দাঁড়িয়ে। দুটো ভাঙা ইটের খাঁজে সে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়ির ঘর থেকে চলকে চলকে জল উঠছে। যদিও ছাদের জলগুলো এখনও নীচে পড়ে যাচ্ছে সিংহমুখ নল দিয়ে। কার্নিশের গায়ে একটা ছোটো বট গাছ হয়েছিল। পিঁপড়েটা একটা বটপাতা মুখে করে কেটে এনেছে। সে সমুদ্রে যেতে চায় না। সে বটপাতাটাকে প্রাণপণে কামড়ে ধরে কার্নিশে দুটো ইটের খাঁজে আটকে আছে দু'দিন হল।
গ্রামের উত্তর দিকে হিমালয়। দক্ষিণদিকে সমুদ্র। বটপাতাতে চড়েই তাকে স্রোতের সাথে লড়াই করে হিমালয়ের দিকে যেতে হবে। মহাদেবের রাগের কারণ পালেদের বউ না। পালেদের বউ আর মহাদেবকে সে অনেকবার রাতে কথা বলতে শুনেছে। মহাদেবকে সে অনেকবার পালেদের জানলার সামনে দুপুরে দাঁড়াতে দেখেছে। মহাদেব পাশের গ্রামে থাকত। পালেদের ছেলে তাকে খুন করিয়ে দিয়েছে। হাইরোডের পাশে জলায় পেট ফোলা মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল। পিঁপড়ে যায়নি। শুনেছে। কিন্তু তারপর থেকে অনেকবার সে পালেদের বউকে পাথরের মহাদেবের কাছে কাঁদতে শুনেছে, একা একা। পাথর, তাই উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু পালেদের বউ ঘরে চলে গেলে, বাতাসকে বলে মহাদেবকে নিজের শরীর থেকে সব ফুল মাটিতে ফেলে দিতে দেখেছে পিঁপড়েটা। দমকা বাতাস সবুজ গ্রীলের ফাঁক দিয়ে এসেছে।
কেড়ে নিলে পাপ হয়। সবাই রাতদিন কেড়ে নিচ্ছে। কেউ সন্তুষ্ট নয়। তাই আশুতোষ রুষ্ট। মন্দিরের পুরোহিতকে এসব কথা বলতে শুনেছে। তার প্রণামীর টাকা কমিয়ে দিত পালগিন্নি। মানে কেড়ে নিত। পাপ করেছে সবাই। বটপাতায় চড়ে জলে ঝাঁপ দিল পিঁপড়েটা। উত্তর দিকে যেতে যেতে নিজের পা দিয়ে দাঁড় বাইতে লাগল। তাকে হিমালয়ের কাছে যেতেই হবে। সবার হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। হিমালয়ে একটা ফাটলে মহাদেব তাঁর পরিবার নিয়ে থাকে, শুনেছে পিঁপড়েটা।