Skip to main content

গুরুদুয়ারার বাইরে এসে যখন দাঁড়ালো কনক তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়। হাতটা জিভে দিয়ে বাকি হালুয়াটা আবার চেখে দেখল। লোভের জন্য নয়। একটা স্বাদ পাওয়ার জন্য। যে স্বাদটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল ভিতর থেকে।

    স্কুটিতে উঠল। কানে এখনও ভজনের সুর আসছে। স্কুটি স্টার্ট করল। দোকান খোলার সময় হয়ে যাচ্ছে যে!

    লকডাউন, করোনা অনেক কিছু নিয়েছে কনকের জীবন থেকে। আজ প্রায় দু'বছর পর এলো গুরুদুয়ারাতে। অভিমান হয়েছিল। ব্যবসা পড়ল, পরিবার তছনছ হল। কিচ্ছু ধরে রাখতে পারল না কনক। যখন নিজেকেও নিজের হাত থেকে সরে যেতে দেখল, ভয় করল। এতদিন জানত দুঃখ, ক্ষতি, শোক সব চাইতে বড় যন্ত্রণা। তা তো নয়! সব চাইতে বড় যন্ত্রণা নিজেকে হারিয়ে ফেলা। নিজেকে চিনতে না পারা। শোক, দুঃখ, ক্ষতিকে অনুভব করার, ঈশ্বরের উপর অভিমান করার তাও একজন থাকে বুকের মধ্যে। কিন্তু বুকের মধ্যে সে-ই যদি হারিয়ে যায় অল্প অল্প করে? এ অনুভব আগে হয়নি কনকের। এ ভয় বড় অদ্ভুত। যেন খাদে পড়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ সাক্ষী থাকার নেই। দরদী না থাকুক। সাক্ষীও থাকবে না? এতো ভীষণ শূন্যতা!

    দোকান খুলল। বিস্কুটগুলো সাজালো। তার বেকারির দোকান। নানকের ছবিটা আবার টাঙালো। ধুলো মুছল। এতদিন অনেক কিছু ওয়াহেগুরুর কাছে চেয়েছে। আজ কিছুর জন্যেই চাইছে না। আজ চাইছে ওয়াহেগুরু তাকে ফিরিয়ে দিক। সে আবার আগের মত হোক। এটা ঠিক, এটাও চাওয়া। তবে বস্তু তো নয়।

    কয়েকজন খদ্দের এলো। গেলো। আজ ভালো লাগছে, বহুযুগ পর ভালো লাগছে। যার নিজের কাছে নিজে আছে, তার সবটুকু আছে।

    কনক রাস্তা পেরোলো, একজন পাগল শুয়ে থাকে রোজ এই সময়, ড্রেনের ধারে। পুরো পাগল না, সব বোঝে, কিন্তু আবার গুলিয়ে ফেলে। কনক এতদিন ওকে ভয় পেয়েছে। আজ বুঝতে পেরেছে কেন ভয় পেয়েছে। সব মানুষের মধ্যেই একটা পাগল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কখনও কখনও নিজেকে সত্যিই মনে হয় পাগল। বাইরের দরজা প্রাণপণে আটকে নিজের ভিতরের পাগলামিকে লুকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু একদিন যদি সেই বাইরের দরজা আটকাবার বোধটাই হারিয়ে যায়?

    আজ প্রথম সে পাগলকে দেখে কনকের কান্না পেলো। পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখল। সে ঘুমাচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর কিছু না বলে তাকিয়ে থাকল কনকের দিকে। কনক দেখল তার চোখের মধ্যে ডুবে, প্রাণীটা আছে, মানুষটা নেই।

    কনকের চোখ ঝাপসা হল। বিস্কুটের প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে বলল, খেয়ো। আমি রোজ আসব এই সময়ে।

    প্রাণীটা তাকালো। কনকের ভিতরের মানুষটা কঁকিয়ে উঠল। যত্ন না করলে গাছে ফুল ধরে না, মানুষই বা বৃন্তে লেগে থাকে কি করে? শিকড়ের দিকে তাকায়নি কেন এতদিন কনক? কি করছিল?

    কনক উত্তর চায় না। নিজেকে চায়। নিজের মধ্যে নিজেকে চায়। জগত নিজের জায়গাতেই থাকে, মানুষ নিজেই টলে যায়।