Skip to main content
uranta wheelchair

মেয়েটা বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা ওটা কি?

বাবা বলল, ওটা কাঠামো মা, ওইতেই দুর্গা ঠাকুর বানানো হয় মাটি দিয়ে। তারপর আমাদের বাড়ির সামনে প্যাণ্ডেলে মা আসে।

মেয়ে কাঠামোর দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের উপর কত সরে সরে যাওয়া ভাবনার টুকরো টুকরো ছায়া। গঙ্গার দিকে তাকালো। সূর্য ডুবে যাচ্ছে ওপারে।

বাবা, দুর্গা ঠাকুর কোথায় আছে এখন তবে?

বাবা মেয়ের দিকে তাকালো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বার করে মেয়ের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, দুর্গা ঠাকুর এখন মাটি হয়ে গঙ্গার সঙ্গে খেলা করছে। আবার যখন শরৎকাল আসবে, অমনি আবার চলে আসবে।

মেয়ে ফ্রকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, বলো তো এটা কে দিয়েছিল পুজোয়?

বাবা একটু চিন্তা করার ভান করে বলল, ঠাকুর্দা তো…… নৌকা চড়বি?

======

বাবা হুইলচেয়ারটা ঘাটে রেখে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে নৌকায় বসালো। মেয়ে বলল, তুমি হাঁপাচ্ছ…

বাবা বলল, তাই তো… এইতেই যদি হাঁপাই তোকে পিঁড়িতে সাতপাক ঘোরাব কি করে বল তো?

মাঝি নৌকা পাড় থেকে ছেড়ে বলল, সে না হয় আমিও যাবখন।

======

সূর্য ডুবেছে। চাঁদ কখন যে আকাশে আগে থেকেই এসে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। মেয়ে নৌকার পাটাতনে শুয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। শুয়ে শুয়েই বলল, আচ্ছা বাবা আমার হুইলচেয়ারটা কেউ নিয়ে চলে যায় যদি… কেউ যদি ভাবে ওটা খেলনা… কারো যদি ইচ্ছা করে ওতে চেপে ঘুরি…

বাবা বলল, চুপ কর… কেউ ভাবে না ওরকম…

আচ্ছা বাবা, তোমার ইচ্ছা হয় চেয়ারটায় বসে এদিক ওদিক যাই…

বাবা বলল, হয় না আবার… হয়… আমি মাঝে মাঝেই ভাবি তোর মা আর আমি দু'জনেই একটা করে কিনে নেব… তারপর তিনজনে বেড়াতে যাব…

মেয়ে হাসল। বলল, না গো, ওরকম বোলো না… খারাপই লাগে যেন… দৌড়ায় যখন সবাই আমাদের বাড়ির সামনে মাঠে… আমার খুব রাগ হয় চেয়ারটার উপর…বলতে বলতে মাঝিকে বলল, ওপারে ওগুলো কি ফুল?

মাঝি বলল, চ... একটা জিনিস দেখাই তোকে আজ…

=======

নৌকা চলল কিছুটা এগিয়ে, অন্যপাড়ের দিকে। ক্রমে মাঝি নৌকা তীরের দিকে আনল। তীরে পর পর পাঁচটা পলাশগাছ। ভর্তি তাতে পলাশ। গঙ্গায় এসে পড়েছে চাঁদের ছায়া। পলাশের ছায়া। মাঝি তীরে বাঁধল নৌকা। হাত বাড়িয়ে বলল, আয়, চ আমার সঙ্গে।

মাঝির কোলে উঠল নীলাঞ্জনা। বাবাকে বলল, এসো।

কাদাতে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দুজনে ঘাসের উপর এসে দাঁড়ালো। একটা শিবমন্দির পাশে। ছোটো। তার সামনের চাতালে বসালো নীলাঞ্জনাকে।

ওপারে চাঁদের আলোয় তার হুইলচেয়ারটা দেখাচ্ছে, এইটুকু। সে বাবাকে আঙুল দেখিয়ে বলল, দেখো বাবা, মনে হচ্ছে যেন আমার পুতুলের…

জয়ন্ত হঠাৎ রেগে গেল। একটু গলা চড়িয়েই বলল, এই চেয়ারটা নিয়ে এত ভাবো কেন? জানোই তো সারা জীবন তোমায়…

রাগটা ফসকে জলে পড়ে গেল। গলা দিয়ে একটা ঝর্ণা আসার আওয়াজ পেল।

নীলাঞ্জনার চোখের জলে চাঁদের আলো। চিকচিক করছে।

মাঝি, বাদল, হাতে করে ক'টা পলাশ এনে নীলাঞ্জনার হাতে দিয়ে বলল, বাবার কথায় কিছু মনে করিস না মা… বড় হলে বুঝবি…

নীলাঞ্জনা বলল, আমি বুঝি, বাবা-ই বোঝে না… চেয়ারের উপর আমার রাগ নেই… আমি খালি দৌড়াতে পারি না বলে কষ্ট পাই… হাঁটতে পারি না বলে না…

জয়ন্ত নীলাঞ্জনার পাশে এসে বসল। নীলাঞ্জনা দুটো পলাশ জয়ন্তের হাতে দিয়ে বলল, এবারে দোলে আমায় পাড়ায় রঙ খেলতে যেতে দেবে? আমি তো থ্রি-তে পড়ি এখন। বড় তো। সামনের বছর ফোরে। তারপর হাইস্কুলে। তারপর কলেজে। যাব রঙ খেলতে?

জয়ন্ত বলল, জানিসই তো সব মা…

হ্যাঁ, ওরা যদি আমায় চেয়ার থেকে ফেলে দেয়… এই তো…

জয়ন্ত চুপ।

তোমার মোবাইলটা দিও। ফেলে দিলে আমি কল করে নেব। আমায় তুলে দিও।

দেখি তোর মা কি বলে…

======

ফিরছে নৌকা। চাঁদটা সরে গেছে অনেকটা। নীলাঞ্জনা বলল, আমি যাব না কোথাও। তুমি মাকে কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না।

কেন রে? জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল।

নীলাঞ্জনা বলল, এমনি।

নৌকা ঘাটে এলো। নীলাঞ্জনা পলাশগুলো দেখিয়ে মাঝিকে বলল, থ্যাংকিউ… আবার যাব…

মাঝি হেসে বলল, তাড়াতাড়ি এসে যেও… নইলে ফুল থাকবে না আর…

নীলাঞ্জনা হাসল।

হুইলচেয়ারে বসল। বাবাকে বলল, মা-কে বোলো না আমরা নৌকা চড়েছিলাম… জানোই তো মা কি ভয় পায়।

জয়ন্ত বলল, যদি বলে কোথায় পেলি পলাশফুল?

নীলাঞ্জনা বলল, বলব, দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিল… আকাশে উড়তে উড়তে…

বাবা-মেয়ে দু'জনেই হেসে উঠল।

বাবা অস্ফুটে বলল, উড়ন্ত হুইলচেয়ার।

 

(ছবি: Suman)