মা আপ আর ডাউন ট্রেন খুব গুলিয়ে ফেলতেন। কাঁচরাপাড়া স্টেশানে কি বিধাননগর স্টেশানে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে, মা অমনি জিজ্ঞাসা করতেন, হ্যাঁ রে এটা কি শিয়ালদা থেকে আসছে না যাচ্ছে?
আমি বকা দিতাম, বলতাম চুপ করো, আশেপাশের লোক শুনলে কি ভাববে, কি মুখ্যু বলবে না?
মায়ের অমনি সটান উত্তর, অত ভাবাভাবির কি আছে, স্টেশানে দাঁড়িয়ে কি তুই দেখতে পাচ্ছিস কোনটা উপরের দিকে, কোনটা নীচের দিকে.... অর্থাৎ আপ আর ডাউনের কথা বলছেন বুঝলাম...
এরপর বড়মামারা সল্টলেকে এলেন। ছোটোমাসিরাও কলকাতায় এলেন। মায়ের কাঁচরাপাড়া থেকে যাতায়াত বাড়ল। একদিন মামার ওখান থেকে ফিরে এসে কি দারুণ খুশী হয়ে, মুখটা উজ্জ্বল করে বললেন, বুঝে ফেলেছি, বুঝলি....
বললাম, কি?
বললেন, আরে ওই তোর আপ আর ডাউন। নীচের দিকে গেলেই কলকাতা, উপরের দিকে এলেই এই নৈহাটি, হালিসহর, কাঁচরাপাড়া, এই তো!
বললাম, শান্তি। এক্কেবারে এই। তা বুঝলে কি করে?
মা খাটে বসে, ব্যাগটা পাশে রেখে, চোখমুখ দারুণ গম্ভীর করে বললেন, আ গেল জ্বালা, না বোঝার কি আছে? ওই যে বিধাননগর স্টেশানে লজেন্স বিক্রি করে রোগা মতন লোকটা আছে না? ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা যে কল্যাণী লোকালটা বলল, সেটা শিয়ালদা থেকে আসছে না যাচ্ছে?
সে অমনি আমায় এই সহজ কথাটা শিকিয়ে দিল, ডাউন, মানে নীচের দিকে নামলেই কলকাতা, আর উপরের দিকে উঠলেই, মানে আপ বললেই এই আমাদের দিকের স্টেশানগুলো আর কি।
বলতে বলতেই মা ব্যাগটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে চেনটা খুলে স্মার্টলি দুটো লেবু লজেন্স আমার হাতে দিয়ে বললেন, নাও, তুমি এইটে খাও... আপ আর ডাউন বোঝাতে কি সব সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বোঝাতে বসেছিলি বাবা আমার বারাকপুর স্টেশানে মনে আছে? সেই সিনেমা দেখে ফেরার সময় সন্ধ্যেবেলা.... আমার মনে হচ্ছিল দিই ঠাঁটিয়ে দুই চড় গালে, ব্যাটা একটা সহজ কথা বোঝাতে গিয়ে আমার উপর মাষ্টারি ফলাচ্ছে... এই দেখ একজন লজেন্সওয়ালা কেমন বুঝিয়ে দিল... তুই ওই সব বইটই ফেলে দিয়ে লজেন্স বেচ ওর সাথে গিয়ে....
আমি ততক্ষণে একটা লজেন্স মুখে পুরেছি। মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনা করছি। মা বিধাননগর স্টেশানে বেঞ্চে বসে লজেন্সওয়ালার কাছ থেকে আপ আরা ডাউন ট্রেনের তত্ত্ব শিখছেন আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে লজেন্স চুষছি... আমার সমুদ্রপৃষ্ঠের তত্ত্ব অনাথ কুকুরের বাচ্চার মত কেঁউ কেঁউ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেশানময়...
মা উঠে যাচ্ছেন, কাপড় বদলাবেন। আমি বল্লুম, তা তোমার বাবা মা যে তোমায় এত লেখাপড়া শেখালো... তার কি হল, শেষে কিনা লজেন্সওয়ালা.. যেখানে তোমার বর স্বয়ং রেলে কাজ করে, তোমার ছেলে কলেজে পড়ে..
ও ঘর থেকে হুঙ্কার... "মেলা লেকচার ঝাড়িস না... নিজের কাজ কর।"
খানিক পর আমার পাশে দু'কাপ চা নিয়ে এসে বসলেন। মুখটা বেশ উদ্ভাসিত। অর্থাৎ নতুন কোনো আইডিয়া। সাথে কিছুটা করুণাও, অর্থাৎ কাউকে কিছু দিতে হবে।
বললেন, আচ্ছা ওকে পুজোয় একটা জামা দিলে হয় না? আমি তো মাঝে মাঝেই যাচ্ছি এখন.... আমায় চিনেও গেছে....
এই ক্ষেত্রে হ্যাঁ বা না বলা আমার এক্তিয়ারের বাইরে। বললাম, হুম, দেওয়া যেতেই পারে।
তারপরেই বললেন, আচ্ছ বাবু যে ট্রেনগুলো বম্বে থেকে ম্যাড্রাস যায়?
মানে?
মানে ওদিকে তো দুদিকেই সমুদ্র বল, কি করে ওরা আপ ডাউন ঠিক করে? সমুদ্রের জলের বাড়বাড়ন্ত দেখে?
বুঝলাম আমায় উত্যক্ত করার চেষ্টা চলছে.. বললাম, কেন ওই স্টেশানের লজেন্সওয়ালারা ঠিক করে নেয়.....
মা হেসে লুটিয়ে পড়ে বললেন, ভাবছি তোকে ওর কাছে টিউশানে পাঠাবো বুঝলি.....
তারপর আমাদের দুটজনেরই হাসি... মামাবাড়ির গল্প ইত্যাদি।
এখনও বিধাননগর স্টেশানে গেলে আমার এই গল্পগুলো মনে পড়ে। লেবু লজেন্স আর লজেন্সওয়ালা - মায়ের পথপ্রদর্শক। আর মনে পড়ে, চন্দনের ফোঁটা দেওয়া মায়ের শান্ত ঘুমন্ত মুখটার কথা.... আপ আর ডাউনের থেকে সে রাস্তা অনেক দূর মা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে....
শুভ জন্মদিন মা। অপেক্ষা কোরো।
সৌরভ ভট্টাচার্য
30 December 2019