মানুষটা ভালোই ছিল। ভালোই থাকে। প্রচুর উৎসাহ, প্রচুর উচ্ছ্বাস। সব ঠিক চলছিল। হঠাৎ করে সে বদলে গেল। থমকে গেল। নিঝুম হয়ে গেল। নিস্তেজ হয়ে গেল। এটা বারবার হতে থাকে। মনের মধ্যে যেন দিন-রাত্রি।
এই অসুখের দুটো নাম, এক, সাইক্লোথাইমিয়া; দুই, বাইপোলার ডিসর্ডার।
প্রথমটা দ্বিতীয়টার ক্ষুদ্র সংস্করণ। সাইক্লোথাইমিয়াতে মনের এই অতিসক্রিয়াবস্থা আর অবসাদের অবস্থার স্থায়িত্বকাল কম হয়। কিন্তু বাইপোলার ডিসর্ডারে দীর্ঘস্থায়ী হয়, অনেক সময় মাসের পর মাস।
অতিসক্রিয় অবস্থায়, বা ম্যানিয়াক দশায় ভীষণ উদ্দাম, উচ্ছ্বাস, অবাস্তব পরিকল্পনা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, অতিরিক্ত কথা বলা, অতিরিক্ত খরচা করে ফেলা, ঘুমের অল্পতা - এরকম ধরণের লক্ষণ দেখা যায়। তেমনই অবসাদের অবস্থায় সম্পূর্ণ নিরুৎসাহ, উদ্দামহীন, খিটখিটে, অস্থির, অতিরিক্ত ঘুম - এ ধরণের লক্ষণ দেখা যায়।
মানুষ বুঝে পায় না সে আসলে কে? কোন অবস্থাটা তার নিজের অবস্থা?
এর থেকে বেরোনোর উপায়? উপায়, ওষুধ খাওয়া। এ রোগ বংশগত।
লেখিকা নিজে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। নিজেও একই রোগে আক্রান্ত। ওনার বাবার এই রোগ ছিল। এ রোগ শুরু হয় ওনার সতেরো বছর বয়সেই। নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে বাইপোলার ডিসর্ডার নিয়ে বেঁচে থাকার এক অসামান্য বর্ণনা। আমি জানি না, 'অসামান্য' শব্দটা ঠিক লিখলাম কিনা। হয় তো না। এক এক সময় দমবন্ধ করা পরিস্থিতি, যখন লেখিকা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন; বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে; নিজের উপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। সে সব বর্ণনা আদৌ সুখকর নয়, কিন্তু বাস্তব তো। তবু হার মানেননি। লড়ে গেছেন। পাশে মানুষও পেয়েছেন। পেয়েছেন কবিতার আশ্রয়। বারবার নিজের কর্মজীবন রোগের এই করাল গ্রাসে পড়েছে। এরই মধ্যে গবেষণা, চিকিৎসা সব চালিয়েছেন। অবশেষে ওনার ভাষায় সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা দেখতে পেয়েছেন।
মন বড় বিচিত্র জায়গা। মন নিজেকে জানান দেয় না। জগতকে জানান দেয়। খানিকটা চশমার মত। নিজেকে জানান যদি সে দেয়, তার মানে হয় কাঁচ ভেঙেছে, নয় ধুলো জমেছে, নয় পাওয়ার এদিক ওদিক হয়েছে। মন যখন নিজেকে জানান দেয়, তার মানে সে ভালো নেই।
মন নানা কারণে 'ভালো নেই' হতে পারে। সবটুকুই যে গল্প করে ঠিক করে দেওয়া যাবে, কি ঘুরু ঘুরু করে, কি সিনেমা দেখে, মার্কেটিং করে, বইপড়ে, গান শুনে… না রে বাবা না। মন মানে এক জটিল রাসায়নিক সমীকরণ। সে সমীকরণে এদিক ওদিক হলেই সব ঘেঁটে যাবে। মনে হবে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বুঝি কালো বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, আকাশের গায়ে ঝুলকালি মাখা হয়ে আছে, আরো কি সব যাচ্ছেতাই সব জিনিস মনে হবে। কিন্তু আসলে কারণটা মনের মধ্যেই। মন বলতে যা ভাষায় বুঝি, সে মন নয়। সে মনের হাঁটাচলা, কথাবলা, আড়ামোড়া ভাঙা - এই সব। আসল মনের নাগাল কি করে পাবে গো, সে তো অঙ্ক, রাসায়নিক পদার্থের অঙ্ক। এদিক ওদিক হয়েছে কি গেছ। আসলে কি জানো, এ গোটা বিশ্ব প্রকৃতির রান্নাঘরের মত। বা বলতে পারো গবেষণাগারের মত। সব মাত্রা যদি ঠিক ঠিক থাকে, তখন এক রকম, আবার এদিক ওদিক হয়ে গেলে আরেক রকম।
আমাদের বাচ্চাদের, কিশোর-কিশোরীদের, যুবক-যুবতীদের এই মনের দিকটা ভালো করে খেয়াল রাখতে হবে জানেন। যদি মনে হয় মাঝে মাঝেই ব্যবহারে অসঙ্গতি দেখছেন, তবে দেরি করা ভালো নয়। কত কত জীবন ব্যর্থ হয়, নষ্ট হয়, অকালে ঝরে যায় শুধু এই রাসায়নিক পদার্থগুলোর অসাম্যের জন্য জানেন? আমাদের দেশে তো তেমনভাবে স্ট্যাটিস্টিক্স রাখা হয় না, রাখা হলে আমরা জানতে পারতাম কত মানুষের মন খারাপ, আদতে গল্পের মন খারাপ নয়; কত মানুষের অবসাদ, আসলে আলোচনা করার নয়; কত মানুষের নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, শুধুমাত্র তাকে আহারে বাছারে করে বোঝানোর নয়।
আমরা যেমন দাঁত দেখাতে যাই, চোখ দেখাতে যাই অল্পবয়সী বাচ্চাদের নিয়েও, তেমনই আমরা নিজেদের মনকে দেখাতে যেতেই পারি। দেখুন না, এই আমি ল্যাপটপে লিখছি, এই ল্যাপটপটা যদি আমার ব্রেন হয়, ধরুন এর মাদারবোর্ডটা মস্তিষ্ক, কিন্তু এর মধ্যে নানা সফটওয়্যার আছে না? ওগুলো মিলেই আমাদের মন। আমাদের মস্তিষ্ক না হয় হল হার্ডওয়্যার, আর আমাদের মন হল সফটওয়্যার। তেমন আমাদের মন যদি কোনো কারণে ঠিক ঠিক কাজ না করে তবে তো আমাদের উচিৎ তাকে নিয়ে ঠিক ঠিক মানুষের কাছে যাওয়া। তেমনই উচিৎ আমাদের নিজেদের মনকে নিয়ে সচেতন হওয়া। বিশেষ করে আমাদের অল্প বয়স্কদের দিকটা খুব ভালো করে দেখা তো উচিৎ।
এখন সমস্যা হল, এই নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো যাবে কি করে? আরো আরো সচেতন হলে অনেক আত্মহত্যা আটকানো যে যায়, সেটা লেখিকাও লিখছেন এই বইতে। চিকিৎসায় ওষুধটা অত্যাবশ্যক।
কিন্তু আমাদের এখানে এখনও মনোবিদকে দেখাতে যাওয়া নিয়ে স্টিগমা আছেই। সেদিন চায়ের দোকানে শুনলাম একটা কথোপকথন।
শুনেছিস, অমুকদা কাজে আসছেন না, ডিপ্রেশানে ভুগছেন বলে।
সেটা কি?
আরে হয় না, যখন কিছু ভালো করে বোঝা যায় না, মানে মনটা সব সময় কনফিউজড থাকে তখন।
কেন হয়?
আরে এ সবের জন্য ডাক্তার লাগে না, বাড়ি বাড়ি এই রোগ। একটু নিজের খেয়াল রাখলেই ঠিক হয়ে যায়। মন খুলে কথা বললেই হয়।
এ অনেকটা সেই "এক যে ছিল রাজা, তার ভারি দুখ" গানটার মত। দুঃখ কিসে যায়? "রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়"... আসলে তো তা নয়!
আমি নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও দেখেছি, বহু মানুষের মানসিক অবস্থা একটুও সুবিধার নয়, কিন্তু ভীষণ সেল্ফ-ডিনায়ালের মধ্যে আছে। নানাভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে আসল অসুবিধা। অলীক আশায় দিন কাটাচ্ছে। এর থেকেও আরো ভয়ংকর হল যে নানা অস্বাভাবিক অনুভূতিকে নানা ধর্মীয়, অধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার আড়ালে ঢেকে নিজের বিপদ ডেকে আনছে। একবার কাগজে বেরোলো, এক তথাকথিত সাধক বাড়ির সবাইকে খুন করে ফেলল মহাদেবের আদেশ পেয়েছে বলে নাকি। এরকম ঘটনা ভয়ানক। এরকম নানা ছোটোবড় ঘটনা তথাকথিত মিস্টিক বা মরমী অনুভূতির ব্যাখ্যায় আরো বড় বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজ যে প্রায়ই পড়ছি মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির মানুষ রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছে পাশাপাশি শুয়ে, এ তো অবশ্যই সুস্থতার লক্ষণ না। সেদিন এক টেলিভিশন অভিনেত্রী বললেন, মেয়েরা নাকি একের উপর আরেক মেয়ের অত্যাচার দেখতে ভালোবাসে, তাই টিআরপি বেড়ে যায়। সুস্থ রুচির কিছু দেখালে কেউ দেখে না। আশ্চর্য কথা, তবে কি আমাদের সমাজ এরকম সব অস্বাভাবিক স্বভাবের মানুষেই ভর্তি? তা হতে তো পারে না। কিন্তু এই নিয়ে কতটা সচেতন আমরা?
কথাটা হল মনের এই নানা আলোছায়ার রাজ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। চাইলেই যা হওয়ার নয়। তার জন্য সঠিক রাস্তায় যেতেই হয়। উপায় অবশ্যই মনোবিদের কাছে যাওয়া। দরকার হলে ওষুধের সাহায্য নেওয়া। অনেক মানুষের জীবন বেঁচে যায় তাতে। যে মানুষকে নানা দোষে দেগে দিচ্ছি, যে মানুষের অস্বাভাবিক ব্যবহারের কড়া সমালোচনা, নিন্দা, তিরস্কার করছি, হয় তো সে জানেই না সে এক মানসিক ব্যাধির শিকার। যে সমালোচনা করছে সেও জানে না। কারণ এই নিয়ে আমাদের শিক্ষিত করে তোলাই হয়নি। আমাদের জানতে হবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শুধু যে নানা মানসিক ব্যাধিকেই চিহ্নিত করা গেছে বা যাচ্ছে তাই শুধু না, সে সবের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায়ও আছে। আমাদের আরো সিরিয়াস হতে হবে। আরো উদ্যমী হতে হবে। সচেতন হতে হবে আমাদের চারপাশ নিয়ে এবং অবশ্যই নিজেকে নিয়েও। কোনো কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসের আশ্রয় না নিয়ে।