Skip to main content
 
       ঘরে ঢুকেই দেখলাম ঠাকুমা মেঝেতে শুয়ে। সব মানুষ মারা গেলেই মনে হয় যেন ঘুমাচ্ছে। ঠাকুমাকেও দেখে মনে হল ঘুমাচ্ছে, শুধু মুখের ডানদিকটা বাঁকা। ঘরে চেনা অচেনা অনেক মানুষ। শোকের বাড়ি আমি গেছি। পরে গেছি। সদ্য শোকের বাড়ি এই প্রথম। আমাদের সাথে ঠাকুমার আর জ্যাঠাদের কোনো সম্পর্ক কোনোদিন ছিল না। এই বাড়িতে আমি প্রথম আসি যেদিন ঠাকুমা'র লিভারে ক্যান্সার প্রথম ধরা পড়ে। মা, বাবা কাঁদছিলেন ঠাকুমার বিছানার পাশে বসে। ঠাকুমা একটা সাদা ওয়াড় জড়ানো কোলবালিশে মাথা দিয়ে সিলিং-এর ঘুরন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। শুকনো চোখ। আমার মনে হল মা অভিনয় করছেন, কারণ মা বাবার অনুপস্থিতিতে ঠাকুমাকে 'খানকি মাগী' বলছে ছোটোমাসিমণিকে আমি শুনেছি। বাবার চোখের কোল থেকে টপ টপ করে বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। বাবাকে এর আগে কাঁদতে দেখিনি, না দেখেছিলাম, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন যেদিন। অফিস থেকে এসে গান চালিয়ে শুয়ে পড়লেন এসিটা বাড়িয়ে। তখন চোখের কোল থেকে এরকম জল পড়ছিল। আমার মনে আছে আমার সেদিন প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়। আমি ভেবেছিলাম বাবা আমার রক্তের কথা জেনে কাঁদছেন। পরে মা ক্যাসেটের উপর ছবি দেখিয়ে বললেন, ইনি তোমার বাবার প্রিয় শিল্পী, তাই... তখন থেকে আমার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনলেই পিরিয়ডের কথা মনে হয়। আমি পছন্দ করি না। মা জোর করে কাঁদছিলেন। কিন্তু কেন? ঠাকুমা'র মন রাখার জন্য? তাও বা কেন?
       আমি বাইরে চলে এলাম। রন্টিদা, জেঠুর ছেলে, বন্ধুদের সাথে বড়ঘরে বসে। চাকরি পেয়েছে সদ্য। রন্টিদা প্রথম আমার ফ্রকের তলায় হাত দেয়। বলেছিল ভালো লাগবে দেখ। আমি তখন ফাইভে পড়ি। বুকে হাত দিয়ে বলেছিল দুপুরে আসিস, আমি ভালো ম্যাসাজ জানি, তোকে করে দিলে ইন ফিউচার দারুণ ব্রেস্ট হবে। বাট কিপ অল দিজ সিক্রেট। রণ্টিদা মুখ নামিয়ে জিভ দিতে দিতে বলেছিল, জাস্ট লাইক পিপারমেন্ট। রণ্টিদা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত, তাই উচ্চারণটা জেঠু-বাবার মত ছিল না। টিট, ভেজাইনা, পুশি শব্দগুলো রণ্টিদাই শিখিয়েছিল। একদিন বাড়াবাড়ি করে ফেলল। কি ব্লিডিং আমার! আমরা বাড়ি ছাড়লাম। মা রন্টিদাকে একটা থাপ্পড় মেরেছিল। জেঠিমা তখন নার্সিং হোমে। ফিরল না আর, ক্যান্সার হয়েছিল।
       এখনও আমার সবটা মনে আছে। আগে রাগ হত, কান্না পেত। এখন ডিপ্রেশান লাগে। যদিও এই ডিপ্রেশানেও ইউজড্ টু হয়ে গেছি। আমার অনেক ফ্রেণ্ডসের এক গল্প, সার্জিকাল স্ট্রাইক অফ ম্যাসকুলিনিজম। এক গল্প। ডিসগাস্টিং।
       জেঠু এখন পুরো অ্যালকোহলিক। আজকেও খেয়ে লাট হয়ে আছে। জেঠু প্রাইমারী স্কুলে পড়াত। খুব কম মাইনে। কবিতা লিখত। তাতেই জেঠিমা লাট খায়। জেঠিমা জেদি ছিলেন ভীষণ। রন্টিদাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে জেঠুর যা ফেটেছিল.... তারপর জেঠিমার প্রিম্যাচিউর ডেথ, জেঠু মালখোর। এই আমাদের পরিবারের হিস্ট্রি। উত্তর কলকাতার পরিবার। আমরা এখন গড়িয়ায় থাকি। জেঠিমা নাকি মাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, তোদের বাড়ি শেয়ালের ডাক শুনতে যাব ছোটো! মা এখনও সেই জ্বালা ভোলেনি। যদিও জেঠিমা আসেনি বা আসার সুযোগ পায়নি।
 
       রন্টিদা একটা নীল টিশার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে বসে। সামনাসামনি কত বছর পর। যদিও ফেসবুকে ফলো করি। রণ্টিদা'র ফিগার দারুণ। পাঁচ আট হাইট। চওড়া কাঁধ। ছিপছিপে গড়ন। শুধু একটু ডার্ক হলে ভালো লাগত। আমার মাইণ্ডের একটা সাইডে একটা ব্লাইণ্ড অ্যাট্রাকশান আছে, আমি জানি। একটা ডিজায়ার। শরীরের কোনো মর‍্যালিটি হয় না। ওটা হিউম্যান, লেট ইভলভড, তাই উইক।
       রন্টিদা'র বন্ধুরা আমার দিকে তাকাল। 'হাই' বলল। চারটে ছেলে। সবাই নিজেদের মোবাইলে মুখ গুঁজে ছিল। আমি ঢুকতেই একটু এম্ব্যারাসড হল সবাই। আমার অস্বস্তিটাও কেটে গেল অনেকটা। একটা ফাঁকা বেতের চেয়ারে বসলাম। ওরা কথা খুঁজছে। আমায় দেখছে।
       আমি ওবিজ। ব্রেস্ট বলতে যা, তা ভারেই বেশি, তাতে অ্যাস্থেটিক কিছু নেই, রণিত বলে। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু, গে। বলে, ওটা নাকি সুনীল গাঙ্গুলির ভাষায়, বিলাতি বেগুন। রণ্টিদা'র বন্ধুদের দেখা হয়ে গেছে। অবশ্যই ওরা নিশ্চয়ই কনসিডার করবে ধরতে দিলেই, হাজার হোক ছেলে তো! একবার মনে হয় রণ্টিদাকে বলি, বিনা মাসাজেই কি বানিয়েছি দেখ! শালা হিপোক্রিট, ফেসবুকে মেয়েদের নিয়ে কবিতা লেখে। ইংরাজিতে।
       আমি বললাম, 'টায় বেরোচ্ছিস, গাড়ি বলা হয়েছে?
       রন্টিদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ি আসছে।
 
       আমি শ্মশানে গেলাম না। মায়ের সাথে থেকে গেলাম। ঠাকুমাকে মা সাজাল। কাঁদল। এই কান্নাটা অভিনয় নয়। মৃত্যু মানুষের ওজন কমিয়ে দেয়। হাল্কা করে দেয়। মানুষ হাল্কা হলে কাঁদে। রণ্টিদা কাঁদছে। প্রচণ্ড কাঁদছে বাবাকে জড়িয়ে। আসলে ঠাকুমাই ছিল এই বাড়িতে ওর একমাত্র বন্ধু। ও পুরো একা এখন। জেঠু ওপর থেকে নামেনি। পাড়ার ছেলেরা জোর করে পরে শ্মশানে নিয়ে গেছে। মুখাগ্নি করতে হয় বড় ছেলেকেই।
 
       আমি মা ঠাকুমা'র ঘরে বসে। মা মাঝখানে ভাত বসিয়ে এলেন। মা কথা বলছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। জেঠিমা'র ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাপুস চোখে কাঁদল। কিন্তু কেন? এদের কাউকেই তো মা সারাজীবন সহ্য করতে পারে না? মানুষ এত মিথ্যা কথা বলে কেন? সে কি চায় না চায় সারাজীবন যেন অনুভব করতেই পারে না। সে নিজের অনুভবগুলোকেও যেন বুঝে উঠতে পারে না।
       আসলে সব অনুভবের একটা উল্টোপিঠ আছে। মানুষ দেখতে পায় না। সময় ঘুরিয়ে দেয়।
 
       সবাই ফিরল সন্ধ্যে ছ'টায়। লাইন ছিল শ্মশানে। মা রণ্টিদাকে ভাত বেড়ে দিল। জেঠু ঘুমিয়ে পড়েছে উপরে। খাবে না। বমি করেছে শ্মশানে। রন্টিদা মাথা নীচু করে খাচ্ছে।
       আমার কান্না পাচ্ছে। এমন অসহায় মুখ আমি দেখিনি। আমাদের পাড়ায় একটা মাতাল ভিখারি মরে গেল একদিন হঠাৎ করে। সারারাত নাকি সে রাস্তার ধারে পড়ে কেঁদেছিল। মুষলধারে বৃষ্টি, কেউ বাইরে বেরোয়নি। সবাই ভেবেছিল মাতলামি করছে। মারা গেল যখন মুখটা হাঁ করা। মুখ ভর্তি বৃষ্টির জল। চোখ দুটো খোলা। কেউ কেউ বলল, মারা যাওয়ার আগে মানুষের খুব তেষ্টা পায়। ও হয়ত জল চেয়ে না পেয়ে বৃষ্টির জল খেতে চেয়েছিল।
 
       আমরা ফিরব। রণ্টিদা'র মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল, এসো আমাদের বাড়িতে। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। মায়ের চোখে অভিনয় নেই। কষ্ট। আমি বলতে চাইলাম, পারলাম না। রণ্টিদার সাদা সাদা আঙুলগুলো দেখে আমার দুটো পায়ের মধ্যে শিরশিরানি অনুভব হল। আমি ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে রন্টিদা'র দিকে তাকিয়ে বলতে চাইলাম, আসিস। বললাম, বাই। রণ্টিদা আমার চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। এই প্রথম এত স্পষ্ট। এত অদাম্ভিক। গাড়ি তখন বড় রাস্তায়।