কারাগার কি শুধু শিকলের হয়? মন নিজে যখন নিজেই নিজের কারাগার হয়ে ওঠে? কিছুতেই নিজেকে ঠেলে নিজের বাইরে যাওয়া যায় না? তখন? সেও এক দুঃসহ কারাগার।
সজল বসাক। গ্রামের প্রথম মুদির দোকান তার ঠাকুর্দার বাবার। এখন চলে না। শীতলা ভাণ্ডারের খদ্দের কমেছে। গ্রামই নেই আর। দেখতে দেখতে সব বদলে গেল। এখন তো আধা শহর। এত আলো, তার দোকানের টিমটিমে ডুম কার চোখে পড়বে? ছেলেটাকে বলেছে, চাকরি কর। আর দোকান না। বিক্রী করে দেবে। লোকও দেখছে।
আজ সকাল থেকে আকাশ ভার। সজল দোকান খুলে, লক্ষ্মী-গণেশ-লোকনাথ বাবাকে ধূপ দেখিয়ে বসেছে সবে। কাগজটা আনা হল না বাড়ি থেকে। কাগজ না থাকলেই মাথায় রাজ্যের চিন্তা বাসা বাঁধে। গোটা অতীতটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে সামনে এসে দাঁড়ায়। সব ভুল করেছে। অতীতটা দেখলেই গা শিউরে ওঠে। এত ভুল মানুষ করে কি করে? হয় তো এখনও কিছু না কিছু ভুল করেছে, আজ থেকে দশ বছর পর বেঁচে থাকলে মনে হবে হয় তো।
পঞ্চাশের দোরগোড়ায় সজল। কিন্তু আর ভালো লাগে না বয়েসটাকে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে। বেঁচে থাকার কোনো তাগিদ অনুভব করে না। সমস্ত সত্তা জুড়ে যেন ঘুণপোকা।
দাদা, কাগজ আনোনি?
রত্না। সেলাই শেখায়। বিয়ে হয়েছিল। সংসার হয়নি। আর বিয়ে করবে না। সজলের থেকে দশ বছরের ছোটোই হবে।
সজল বলল, না রে…
বলতে বলতে হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামল। এদিকে বাইরে রোদ। রত্না দোকানের মধ্যে ঢুকে এলো। বসল। এ রত্নার রোজকার নিয়ম। কাগজ পড়তে আসে।
রত্না বলল, কি সব ভাবছিলে? এখনও কপালে দাগ মেলায়নি….
সজল বলল, ভালো লাগে না রে রত্না…. কিচ্ছু ভালো লাগে না… জীবনটা মাটি করলাম নিজের হাতে….
রত্নার মুখের সহজ ভাবটা কেটে গিয়ে গম্ভীর হল। বলল, তুমি কিন্তু আবার ডিপ্রেশানে যাচ্ছ। গতবার বিষ খেয়ে কি কাণ্ডটা করেছিলে.. আর না। কেন ওসব ভাবো বলো তো? যারাই জীবনকে নিয়ে ভাবে তারাই তোমার মত বিষাদগ্রস্ত হয়। ভাবো কেন দাদা? জীবন কি ভাবার জিনিস? বাঁচার জিনিস। আমি যদি ভাবতাম তবে গলায় দড়ি দিয়ে দিতাম দাদা। ভেবো না।
সজল বলল, না ভেবে আমি যে থাকতে পারি না রে… তাছাড়া ভাবার কি আছে বল… এ তো স্পষ্টই যে আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না জীবনে…. কিচ্ছু না।
সজলের কান্না পেল। চোয়াল, নাক, চোখ কান্নায় টাটিয়ে উঠল। অভিমানের কান্না বড় চড়া।
রত্না বলল, তুমি মরবে দাদা… এত অভিমান ভালো না… সে মানুষের উপরেই বলো আর ভগবানের উপরে…. আখেরে নিজেরই ক্ষতি…. আমি এই সার বুঝেছি… আমার নিজেকে নিয়েও কোনো অভিমান নেই দাদা…. কি হবে বলো… ভাগ্য বলো… কর্মফল বলো… ভবিতব্য বলো… অদৃষ্ট বলো… ঈশ্বরের ইচ্ছা বলো…. এসবেরই কোনো মানে নেই। আসল কথা হল জীবনের ওদিকে বসে আরেকজন কেউ চাল দেয়। তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার চাল এত পাকা দাদা তার সঙ্গে যোঝা খুব কঠিন… হারজিতের হিসাব খতালে সে-ই জেতে বেশী।।
এতক্ষণে আকাশ কালো করে এসেছে। রত্না বাইরের দিকে তাকিয়ে। যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে।
আমার যখন সংসার গেল… একা এসে দাঁড়ালাম.. আমার খুব অভিমান হত.. খুব… তারপর কি এক রোগ হল প্রায় মরো মরো হলাম… জানো তো সব…. মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে সেই সময় মনে হচ্ছিল আসলে আমি ছাড়া আমার কি আছে সংসারে বলো… কিচ্ছু নেই…
সজল রত্নার কথা শুনতে শুনতে কখন নিজেকে ছাড়িয়ে এসেছে। রত্নাকে বলল, তোর আবার বিয়ে করতে ইচ্ছা করে না রে…কাউকে ভালো লাগেনি?
রত্না তাকালো না। চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, দাদা, যে নিজেকে নিয়ে একবার বাঁচতে শিখেছে সে আর সমাজের ভালোবাসায় ডোবে না, না শরীরের জন্য ডোবে। না শরীর, না সমাজ। দুটোর ডাকই বাইরের। প্রাণের ভিতর ডাক পাঠাতে পারে এমন তো কাউকে দেখলাম না দাদা….
সজল হো হো করে হেসে উঠল। রত্নাও হেসে উঠল।
সজল বলল, চা খাই চল।
রত্না বলল, চলো।
বৃষ্টি ধরে গেছে। রত্না আর সজল বিপুলের চায়ের দোকানে বসে। কেউ কথা বলছে না। কিন্তু বুকটা কি হাল্কা। মানুষ কথা বলবে বলেই তো কথার আবিষ্কার। কথা দিয়ে মনের মেঘ কাটে। কথা দিয়ে বৃষ্টি হয়। কথা দিয়ে ফসল বোনে। কথাতেই মানুষ বাঁচে। চিন্তা মানে তো একমুখী কথা। বন্ধু মানে উভমুখী। রত্নার দিকে সকৃতজ্ঞ তাকালো সজল। রত্না। বড় ভালো মানুষ। বন্ধু।