Skip to main content
paramasundari

কথা হল এমন একটা জায়গায় গিয়ে তো দাঁড়ানোই যায় যেখানে মাস্কহীন হতে মনে বেশি সংশয় জাগবে না। এমনিতে আমার দুর্গাপুজো মানেই ঘরের কোণে নতুন বই নিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া। ছোটো ছিলাম যখন ছিল নানা পূজাবার্ষিকী, এখন হল নানা অন্য ধরণের বই।

    সে যাক। কোথায় যাওয়া যায়? ঠিক হল রামপ্রসাদের ভিটে। বেশি দূর নয়, বাইকে দশ মিনিট মত। বেশ ফাঁকাই থাকে। বেশ বড় প্রাঙ্গণ।

    পৌঁছালাম। যেমন ভেবেছিলাম তেমনই ফাঁকা ফাঁকা বেশ। এবারের পুজোর অভিজ্ঞতা আমার একেবারে অন্যরকম হচ্ছে। যেমন আমাদের পাড়ায় মাইক নেই এবারে। যে সিদ্ধান্ত একেবারেই বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে যথাবিহিত বিচার। সাধুবাদ জানাই তাদের। শুধু তাই নয়, ছাদে উঠলেই আগে যেমন মান্না, লতা, আশা, কিশোর, অভিজিৎ ইত্যাদিরা কানের ভিতর দিয়ে মরমে ধামাল লাগিয়ে দিত, এবারে তা নেই। ভীষণ শান্ত চারদিক। আজ বেরিয়ে দেখলাম ভিড়ও যথেষ্ট কম। পুজোর সময় সন্ধ্যেতে কোথাও বেরোনো আমার কাছে প্যানিক লাগে, আজ দেখলাম কই ভিড়? স্বস্তি পেলাম। একটু বিষণ্ণও হলাম। কতটা ঝড় গেলে মানুষ উৎসবেও এমন নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তবে যাই হোক, এই ভালো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। উপায় নেই যে আর!

    ভিটেতে এসে মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়ালাম। ছবি তোলা বারণ তাই ছবি তুলে দিলাম না। আহা, কি সাজ সাজিয়েছে গো! চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রাণে এসে শীতল বাতাস লাগল। এমন অপরূপ রূপ!

    এরপরেই ঘটে গেল যাকে বলে এক্কেবারে আশ্চয্যি কাণ্ড।

    কি হল বলি। আমি তো মন দিয়ে, চোখ মেলে অমন অপরূপ সাজ দেখছি মায়ের। মায়ের পরনে লাল বেণারসী। তাতে এমন সুন্দর গয়নার বাহার। উজ্জ্বল আলোয় প্রফুল্লিত প্রসন্ন আনন মায়ের। প্রদীপের শিখা লেগে নাকের নথ চকচক করছে। ঝাড় লণ্ঠনের আলোয় বুকের কাছে গয়নাজুড়ে ঠিকরে পড়ছে আলো। কি মাধুর্য।

    কিন্তু আমার মনে মনে কি যেন একটা গান বাজছে! আমার অবচেতনের মন গুনগুন করে গাইছে। কি গান? কি গান? হায় কপাল! একি হল আমার! আমার ভটচায্যি গুষ্ঠীর পূর্বপুরুষ যদি আমার মনের কোণে একবার কান পাতেন তো আমায় কি কি শাপ দেবেন? কি প্রায়শ্চিত্ত করাবেন?

    ভাবা যায়?... সে গান রামপ্রসাদ না, খোদ যার ভিটেতে দাঁড়িয়ে, কমলাকান্ত না, প্রেমিক না, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল না... আমার মনে কি বাজছে?.... হায় মেরি পরম পরম পরম পরম পরম সুন্দরী... হায় মেরি পরম পরম পরম পরম পরম সুন্দরী....


     এই হল সোশ্যাল মিডিয়ার ফল। বুঝলাম। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। কিন্তু এমনই বেহায়া মন আমার যে আমি গানটা ধরে ফেলা সত্ত্বেও কিনা লজ্জায় থামল না! আস্পর্ধা দেখো, আবার তক্ক করে মনে মনে!

    অবশ্য তার যুক্তিগুলিই বা ফেলি কেমন করে। মানব সন্তান পৃথিবীতে চোখ মেলার পর সুন্দরের সঙ্গে পরিচয় তো হয় মাকে দিয়েই! মায়ের গায়ের গন্ধ, মায়ের গলার আওয়াজ, মায়ের বুকের ধকধকানি, মায়ের উষ্ণতা, মায়ের হাসি, মায়ের বক্ষসুধা... এই তো প্রথম সুন্দরের সঙ্গে পরিচয়। মা-ই তো পরমসুন্দরী। তারপর যে না সুন্দরের নানা সংজ্ঞা, নানা পরিচয় হয়। কিন্তু মায়ের সামনে সব তুচ্ছ। শঙ্করাচার্য বলছেন মায়ের সামনে দাঁড়ালে মানুষের অতিহীন চিন্তাও মিলিয়ে যায় ছায়ার মত। তবে? চিত্তে মায়ের উপস্থিতিই যদি মনকে এমন হীনতা মুক্ত করে দেয়, মায়ের ধ্যানই যদি মনকে সব সঙ্কীর্ণতা, মলিনতা থেকে মুক্তি দেয়, তবে সে মাতৃতত্ত্ব নিজে না জানি কত সুন্দর। এ যে বুঝেছে সে-ই বুঝেছে। একি আর যুক্তিতর্ক করে সমাধান হয়? এ সমাধান হয় চিত্তের গভীরে ডুব দিয়ে সে মাণিক খুঁজতে চাইলে তো!


    তবে মা আজ এই গানই থাক। তুমিই সেই পরমসুন্দরী। তুমিই জ্ঞানের, বোধের, ভক্তির অবেশেষে শেষ চরম বিন্দু, পরমসুন্দর তুমি। তুমি তুমিই হও। চেতনার সৌন্দর্য জগতের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য, তুমি সেই দাও.... তাই দাও... মা... তাই দাও।