Skip to main content
কাপড়খানা নিয়ে তার আর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। খুব দামী কাপড়। তার গুরুর শরীর জুড়ে থাকত এই বস্ত্র। তাঁর শেষ স্মৃতি এটি, এ কি হেলা করবার জিনিস! একটু দাগ যেন না লাগে, গন্ধ যেন না হয়। আহা, কি ধবধবে সাদা! গুরুচরিত্রের মতই শুভ্র। সে যত দেখে তার চোখ তত যায় জুড়িয়ে। কিন্তু কি করে রাখবে সে একে খাঁটি? 
 
অনেক ভেবে সে গেল নগরের সবচেয়ে নামী কাঠের কারিগরের কাছে। অনেক দাম দিয়ে খুব যত্ন করে বানিয়ে আনল একটা সিন্দুক। রাখল তাতে তার শ্বেতশুভ্র বস্ত্র। দিন যায়। রোজ সে বার করে দেখে তার কাপড়খানা। খুশী হয়ে রেখে দেয়। 
একদিন তার চক্ষু চড়কগাছ! একি কাপড়ে ফুটো করলে কে? হায় হায়! খুঁজে বার করল এক পোকার পরিবারকে। পুড়িয়ে মারল তাদের সিন্দুকশুদ্ধ! রাগে তিন দিন ঘুমালও না, খেলেও না ঠিক করে। 
তারপর নদীর ধারে গিয়ে কাচতে বসল। কি জানি পোকার ডিম আর গন্ধ মিশে থাকে যদি সূতোর ভাঁজে ভাঁজে। তার চোখ থেকে দু'ফোঁটা জল পড়ল কাপড় ছুঁয়ে নদীর জলে। হায় গুরুদেব! 
তারপর একটা পরিস্কার ডালে মেলে দিল কাপড়খানা। সে নীচে থাকল প্রহরায়। 
বসে বসে কখন তার দু'চোখ এসেছে জুড়িয়ে। একে তিন দিনের না ঘুমোনো, তায় নদীতীরের এমন ঠান্ডা হাওয়া। ঘুম তো আসবেই। বেলা গেল।
চোখ মেলতেই তার হৃৎপিন্ড গলার কাছে এল লাফিয়ে! কাপড় লুটিয়ে ধুলায়! আর্তনাদ করে উঠল সে, হায় প্রভু! কি করলাম আমি!
অনেক কাঁদল, মাটিতে গড়াগড়ি দিল, নাক খৎ দিল। প্রতিজ্ঞা করল, আর সে হবে না অসাবধান।
তারপর সারারাত ধরে সে কাপড়খানি আবার কাচল। শুকালো, না ঘুমিয়ে।
যখন সে ফিরছে তখন পূবাকাশ লাল।
পথে কে যেন ডাকলে। দেখল এক তরুণী - কাঁখে কলস, মাথায় চাঁপা, তার দিকে চেয়ে। সে বললে, "কি?"
মেয়েটি হেসে বললে, "বলছিলাম, কি সুন্দর কাপড় তোমার হাতে! আমায় দেবে? আমি রঙীন করে নিয়ে আসব?"
তার মাথা উঠল গরম হয়ে, মনে মনে বলল মূর্খ! মুখে শুধু বললে, "না"।
ফিরে এসে তার দুশ্চিন্তা গেল আরো বেড়ে। কি করে সে!
অবশেষে ঠিক করলে নিজের বুকের সাথেই রাখবে বেঁধে, দিনে রাতে। দেখি কেমন করে হয় মলিন!
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
দিন যায়, বছর যায়। কাপড় থাকে তার বুকে বাঁধা, রাতদিন। তবে মাঝে মাঝে সেই চাঁপা ফুলের গন্ধ লাগে তার নাকে। সে লজ্জা পায়। ক্ষমা চায় গুরুকে স্মরণ করে।
সে দিন জন্মাষ্টমী। খুব বড় করে উৎসব নগরে। দুরদুরান্ত থেকে কত মহাত্মারা এসেছেন। সবাই গেছে মন্দিরে। সেও গেল। কিন্তু দরজায় দারোয়ান দিলে আটকে। বললে, "তোমার সারা গায়ে কি দুর্গন্ধ! স্নান করে এসো ঠাকুর।"
কিন্তু সে তো রোজই স্নান করে গোদাবরীর জলে। তবে কি কাপড়খানাই?
ঠিক তাই!
ছুটলো সে গোদাবরীর তীরে। কিন্তু একি!
একবার ধুলো, দু'বার ধুলো, শতবার ধুলো। গন্ধ যে যায় না। তার নিজের সারা গায়ের গন্ধ মিশে তাতে!
ওদিকে পূজোর লগ্ন যাচ্ছে বয়ে। মন্দিরে পূজার ঘন্টা, স্তোত্র তাকে করে তুলছে চঞ্চল! সে অসহায়ের মত বসে রইল নদীর তীরে। তার দু'চোখের জল ভেসে যাচ্ছে গোদাবরীর পূণ্যধারায়। কতক্ষণ এভাবে গেল।
ক্রমে তার মন উঠল বিষণ্ণ হয়ে, "আমায় ত্যাগ করলে ঠাকুর!"
বসল গিয়ে একটি ঢিবির উপর। স্থির করলে আত্মবিসর্জন দেবে গোদাবরীর জলে।
এই ভেবে, চোখ বুজে অন্তিম বারের মত স্মরণ করছে তার গুরুর চরণ, এমন সময় কে যেন তার গায়ে রাখল কোমল হাত।
তাকিয়ে দেখল একটি বালক। কালো তার গা, কোমরে গোঁজা বাঁশের বাঁশি।
বললে, "ঠাকুর তোমার কাপড়খানি দেবে? আমরা বন্ধুরা খেলছি ওই আমবনের ধারে। ভীষণ কাঁটা, তাই বসতে পারিনে। তোমার কাপড়খানি বসি বিছিয়ে?"
তার চমক ভাঙল। কি যেন হল বালকটির স্পর্শে, তার অভিমান গেল ভেসে। বালকটির মুখে যেন কতকালের চেনা হাসি। সে দু'হাতে জড়িয়ে ধরলে তাকে। বললে, "নিয়ে যাও। এ কাপড় আজ থেকে তোমার। শুধু বলো কে বলে দিল তোমায় আমার কাছে আসার পথ?"
বালক বললে, "চিনি নে ঠাকুর। তবে সে দিল এই ফুল আমার হাতে। আর বললে এটি দেখিও তাকে, তিনি চিনবেন।"
বালকটি তার হাতে দিল একটি চাঁপা ফুল।
সে হাতে নিয়ে বললে, "কোথায় সে?"
বালকটি বললে, "মন্দিরের দ্বারে গো, তোমার অপেক্ষায়।"
তার মুখখানি হয়ে উঠল উদ্ভাসিত।
মন্দির থেকে আসছে সন্ধ্যারতির আওয়াজ। সে ছুটলো।