Skip to main content

ঝুলনের এ কদিন স্টেশানেই রাত কেটে যায়। বেলায়, ওই চারটের পর আবার মেলায় আসে। ঝুলনের এক হপ্তা আগে থেকেই মেলা বসে যায়। এবারও বসেছে। সেও এসেছে। সে ডালের বড়া বিক্রি করে। ছোটো-ছোটো। ফুলুরির মত। ওজনে বেচে।

তার বয়েস হল আটান্ন। একা মানুষ। মেয়েদের বিয়ে হল। বউ মারা গেল।

রাস্তায় আলো নেই আজ। চাঁদও আধখানা উঠেছে। অশ্বত্থের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। সে ভ্যান নিয়ে ফিরছে। লম্ফটা নেভানো। কালো কড়াই নিভানো ঠাণ্ডা ওভেনের উপর খড়খড় করছে। ওইটুকুই আওয়াজ।

সে ভ্যান থেকে নামল। তলপেটে চাপ লাগছে। জোর চেপেছে। অভ্যাস মত কানে পৈতেটা জড়ালো। দুটো সুতো ছিঁড়ে গেছে। পাল্টাতে হবে। যা হোক মহালয়ার আগে বদলে নিলেই হবে। তর্পণ আছে।

ফিরে ভ্যানে উঠতে যাবে, কে যেন বলল, "এমন ফ্যাকাসে মুখ কেন রে?"

কেউ নেই। রাস্তা শুনশান। স্টেশান আরো চল্লিশ মিনিট। কে বলল?

সে নেমে এদিক ওদিক তাকালো। চাঁদটা অদ্ভুত লাগছে। মালতী থাকলে বলতো, আরে দাঁড়ালে কেন…. আমার ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে যে… মালতী ভ্যানেই ঘুমিয়ে পড়ত।

সে ভ্যানের দিকে তাকালো। কালো কড়াই ওভেন আর ডাল মাখার বড় গামলাটা, তার মধ্যে রাখা ফাঁকা জগ।

হ্যাঁ হেরেই গেছে সে। ক্লান্ত হয়ে গেছে। কি যেন হয়েছে তার।

"শোন না ভাই… একটু গঙ্গার দিকে ভ্যানটা ঘোরা না… চ…. তোর লাভ বই ক্ষতি হবে না…."

সে এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। কে রে?

কে অবশ্য বুঝতেই পারছে। কিন্তু তার পিছনে কেন? সে হাতজোড় করে বলল, আমায় যেতে দিন না মশায়…. বামুন মানুষ আমি… কারোর কোনোদিন ক্ষতি করিনি…. আর আমার কাছে আপনার পাওয়ারও কিছু নেই…

"আহা, ওরে ভয় পেয়ে গেলি যে রে… আমি দেহহীন সত্যিই, তাই বলে কি কাণ্ডজ্ঞানহীন… শোন কথা বাড়াস না…. গঙ্গার দিকে চল।"

========

মেলা থেকে গঙ্গাটা স্টেশানের উল্টো দিকে। কিন্তু এ যা শুরু করেছে যেতেই হবে। তা ছাড়া এখনও তো প্রায় দশদিন এ রাস্তা দিয়ে এত রাতেই ফিরতে হবে তাকে। তবে?

অগত্যা সে ভ্যান নিয়ে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়ালো। সারা রাস্তা শুধু কানের কাছে গুনগুন গান শুনতে পাচ্ছিল…. দে মা আমায় তবিলদারি…

সে বলল, বলুন… এবার?

"এবার আর কি… ওদিকে দেখো যতীন ভায়া…. ওই যে… মন্দিরের সামনে চাতাল…. স্টেশানে না রাত কাটিয়ে এখানেই কাটাতে পারো… আমার দুই বন্ধু আছে বলে দেবখন।"

যতীন বলল, আপনার বন্ধু মানে… তেনারাও কি….

"সে আর বলতে… বিলক্ষণ… বিলক্ষণ… তবে দু’জনেই বড় ভালো গো ভায়া…. ওরা নেই… কাশী গেছে… কালই ফেরার কথা।"

যতীন গঙ্গার ধারে বসে পড়ল। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। খানিক চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমাকে আপনার কি দরকার, সেটাই তো বললেন না।

"তেমন দরকার কিছু নেই বুঝলি। আসলে তোকে কদিন ধরে দেখছি, ভালো মানুষ তুই। কিন্তু বোকা। এখন বিবাগী। দেখ বোকা বিবাগী যারা হয় তারা রাতদিন শুধু ঠকে। তাই ভাবলাম…. আসলে আমি ভালো মানুষ ছিলাম না। চুরি ডাকাতিতে বেশ নামডাক ছিল। ওই পুলিশের গুলিতেই…. যা হোক, আমার মনে হল তোকে কিছু একটা বলি। আর দেখ আজই তুই মুততে আমার গাছের তলাতেই দাঁড়ালি। এ মায়ের যোগাযোগ ছাড়া কি…. বল…."

যতীনের "বোকা" কথাটায় গায়ে বিঁধল। বলল, সে সংসারে কত বোকা মানুষ আছে দাদা…. তুমি কতজনকে বাঁচাবে…. তাছাড়া তোমার মতলবও তো স্পষ্ট নয়….

"বুঝেছি। অভিমান হয়েছে। দেখ, কিরকম বোকা তুই… বলা নেই, কওয়া নেই, হুস করে এক ভূতের উপর অভিমান করে বসলি… তাও যদি চোখে দেখা মানুষ হতাম…. এই হল তোর বোকামি…. কথা অবশ্য সত্যি বলেছিস… কত বোকাকে আমি সামলাব…. যা হোক… নিজেকে সামাল দে যতীন, এত অভিমানী হলে সংসারে চলে না…."

যতীন চুপ করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। চাঁদের ফিকে আলোয় কি মায়াময় লাগছে সবটা। হ্যাঁ সে অভিমানী। অত পড়ালেখা করেনি সে। তার অভিমানী মন নিজেকে গুটিয়ে রাখে। মালতী চলে যাওয়ার পর আরো বেশি করে। কিন্তু অভিমান কেন হয় তার এত?

"বোকা বলে রে… বোকা বলে। দেখ যা হওয়ার তা হবে। কতটুকু তোর হাতে জীবন বল? নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে যদি অভিমান করে নিজেকে দূরে ঠেললি, তবে হেরেই গেলি। অভিমানের কোনো মূল্য নেই। ওটা শোকের অপচয়। অভিমান মানে সময়ের অপচয়, মনের অপচয়, জীবনের অপচয়। বোকামি না এটা?"

যতীনের কান মাথা গরম হয়ে গেল। একে সকাল থেকে এত পরিশ্রম গেছে তায় আবার এই রাতবিরেতে ভূতের কেত্তন। সে বলল, একটু ঝাঁঝিয়েই বলল, তা অভিমান না করলে আমি রাতারাতি বুদ্ধিমান হয়ে গেলাম নাকি?

"বোকা রে। বুদ্ধিমান কেউ হয় না। নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবাই তো আরো বড় বোকামি। নিজেকে বোকা চিনতে পারাই আসল বুদ্ধিমানের কাজ। আমি আজ যাই। আমাকে একটু শ্মশানের ওদিকে যেতে হবে। তুই বসে বসে ভাব। আর যাই করিস এত অভিমানী হোসনি…. এলাম বুঝলি"।

=======

মেলায় আজ ভিড় কম। ট্রেনের কি গোলমাল নাকি। যতীনের বিক্রি-বাট্টা কম। যতীনের নিজেকে আজকে কি হালকা হালকা লাগছে। নিজেকে সকাল থেকে উঠেই কি চমৎকার বোকা বোকা লাগছে। যত বোকা লাগছে মনে হচ্ছে যেন কে শার্টের একটা একটা বোতাম খুলে দিচ্ছে। বুকে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে। নিজেকে বোকা ভাবতে শুরু করলে চারদিকে কে কত বুদ্ধিমান সে হিসাব আর কষতে হচ্ছে না। এ বেশ তো! মাথাটা দারুণ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তবে তো সে দাদাকে একটা ধন্যবাদ জানাতে হয়…. কিন্তু সত্যিই কি নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবত সে?

যতীন সারাটা দিন ভেবে রাতের বেলা গঙ্গার ধারে বসে বুঝল, আসলে সে নিজের বোকামিগুলো নিয়ে মাথাই ঘামাত না। বোকামিগুলো যে তারই স্বীকার করত না। এর ওর ঘাড়ে দায় চাপাতো। এমনকি মালতীরও…..

আজ প্রথম মনে হল মালতীর সঙ্গে যা করেছে আজীবন…. ঠিক করেনি…… বড্ড হেলা করেছে…. কি বোকা সে…. কি বোকা…..

আফসোসে বুকটা ভারী হয়ে গেল যতীনের। ভ্যানে গিয়ে বসল। আর মেলায় থাকবে না। ঘরে যাবে। মালতীর জন্য কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মালতীকে সে একটুও বোঝেনি। বুঝতেই চায়নি। নিজের হাত-পা এর মত মালতীকে ধরে নিয়েছিল। ছি ছি।

ভ্যান গড়াতেই পিছন থেকে কে বলে উঠল…. এ জায়গাটা কিন্তু মন্দ না….. থাকবে?

যতীন লাফ দিয়ে নামল ভ্যান থেকে….. কথা বলতে পারছে না….. গলা কামড়ে ধরে আছে কে?.....

বোকামি…. মালতী… আজীবনের বোকামি….

মালতী বলল, জানতাম তো…. তুমি আজ জানলে…..