বাড়ি ফেরার পথে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেটে দুমড়ানো দশটাকার নোট। বার করে বলল, দিন।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত তখন। দোকানে কয়েকজন শেষবেলার খদ্দের। খবরের কাগজের উপর রাখা আলুর চপগুলো সরিয়ে গুঁড়োগুলো এক জায়গায় করে, একটা ঠোঙার মধ্যে ভরে বলল, নে।
ছেলেটা সাইকেলে উঠে দোকানের দিকে তাকালো। শীত ভাঙছে দুমড়ে মুচড়ে কাঠের আগুন। রেল কারখানার কাঠ। ভাঙা কাঠ। দোকানের বালবে তেলের চিটে লেগে। দোকানি তার দিকে তাকাচ্ছে আড়চোখে। দোকানি তাকে জন্মাতে দেখেছে। তার বাবাকে মারা যেতে দেখেছে। মা-কে ধীরে ধীরে রেলকলোনির একটা একটা বাড়িতে কাজে যাওয়া শুরু করতে দেখেছে। সাজপোশাক বদলে যেতে দেখেছে। হাঁটাচলা, কথাবলা বদলে যেতে দেখেছে। বালব্ কি আর এমনিই তেলচিটে হয় রে?
সাইকেলের প্যাডেলে পা চাপল। তার পনেরো বছর বয়েস। বাবাকে মনে নেই। কিন্তু এই চপের কাকুকে দেখলে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। পাশে বসতে ইচ্ছা করে। তেলচিটে বালবের নীচে বই খুলে বসতে ইচ্ছা করে। বকুনি খেতে ইচ্ছা করে।
লজ্জা লাগে ভাবতে। নিজের লোভকে বলে, মর, মর, তুই মর।
=======
পরপর দুটো বিয়ে বাড়ির বাজনা বাজানোর কাজ। যা খায় অম্বল হয়ে যায়। তবু আজ দুটো বেগুনি আর চা খেল। ঊনষাট কেমন করে লেখে? কেউ লেখে ঊনষাট? তার বয়েস। চপের দোকানিকে এ কলোনিতে আসতে দেখেছে। আগে ভ্যানে সব্জী বিক্রি করত। হাইড্রোসিল না কি রোগ হল। খারাপ রোগ। তারপর থেকে চপ ভাজে।
সাদা আর লাল টুপিটা মাথা থেকে খুলে বেগুনিতে কামড় দিচ্ছে। জিভে স্বাদ নেই। আঙুলগুলো তেলচিটে হয়ে যাচ্ছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সাইকেলে চলে যাওয়া ছেলেটাকে দেখল। ওর মাকে চেনে। অসভ্য মেয়েছেলে। বর মারা যাওয়ার পর…..
বুকের কাছটা জ্বালা ধরছে। অম্বলের ঢেকুর উঠতে শুরু হল। এখনই উঠে গেলে হয়। টাকাই তো যাবে। কিন্তু না। নিজের উপর অত্যাচার করতে ভালো লাগে। শোধ তুলতে নিজের উপর ভালো লাগে। কিছু দেয়নি জীবন তাকে।
কাঠের আগুনের দিকে তাকিয়ে। তারও সময় এসেছে। আগুনে পোড়ার। এসেছে কি? না। যেন এসে চলে গেছে। যমের অরুচি। এত এতদিন অকারণ বাঁচতে অসহ্য লাগে। এক একবার মনে হয় পাশেই তো রেললাইন। নিজেকে সুযোগ করে দিলেই হয়। দেয় না।
আগুনে হাত সেঁকতে সেঁকতে বলল, আজ বড় ঠাণ্ডা রে।
কেউ উত্তর দিল না। বেগুনি চিবানোর আওয়াজটা বাড়িয়ে দিল। চায়ে চুমুক দেওয়ার আওয়াজটা জোরে করল। সামনের কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে সামনে এসে দাঁড়ালো। এক টুকরো বেগুনি ছুঁড়ে বলল, মর।
======
হাওয়া দিয়ে দাও তো…
সাইকেলে বসে বসেই দেখল পাশের চপের দোকানে তার শ্বশুর। বুড়ো এখনও গিলছে বসে। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে নামল।
বাড়িতে মানুষ বলতে সে আর ওই বুড়ো শ্বশুর। বর আর শাশুড়ি করোনায় মরেছে। বুড়োটা মরতে মরতে বেঁচে গেল। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল ভালো হল। কেউ তো আছে। এখন মনে হয়, আপদ!
সাইকেলে হাওয়া দিচ্ছে লোকটা, কিন্তু তাকাচ্ছে না আজকে তার দিকে। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। পাগল অবশ্য আছেই।
এই, কি হল, কি বকছ?
তোমার আর কি… দশ বাড়ি কাজ করো…. বাচ্চাকাচ্চা নেই… ঝাড়া হাত-পা… আমার বড়টা হাত ভেঙে বাড়ি এসেছে আজ…. ডাক্তার বলছে এখানে হবে না…. কলকাতায় নিয়ে যাও…. প্লেট বসবে…..
এরকম অশান্তিকে হিংসা করে সে। আঁচলে কপালের মিথ্যা ঘাম মুছে বলল, ইস্….. কি যে করে…. তোমার বউ কি বলছে?
ওর কি…. ন্যাকা মেয়েছেলে…. কেঁদে যাচ্ছে…. যেন মরেছে….
ওর বউয়ের উপর রাগ হয়। এমনি এমনিই রাগ হয়। সাইকেলে হাওয়া দিতে দিতে ওর চাহনিতে যত্ন দেখে। ভীষণ যত্ন। ওর বউয়ের উপর রাগ হয়। আরো রাগ হয়। যেন যত্নের মানে বোঝে না সে। সে একাই বোঝে। শ্বশুর তাই যখন কুকুরটাকে বলল, মর… কথাটা ভালো লাগল। কিন্তু কাকে বলল, নিজেকে, না ওর বউকে?
চপের দোকান ফাঁকা। সাইকেলের দোকানি চপের দোকানির সঙ্গে কথা বলছে। সাইকেলে উঠে চলে গেলেই হয়। কিন্তু এখনই না। ভালো করে “যাই” বলে তবেই যাবে।
শ্বশুর টোটোতে বসে। আরো বাজনদারদের সঙ্গে। বিয়েবাড়ির খাওয়া সহ্য হবে না। দুটো রুটি নেবে? ইচ্ছে করছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে। ইচ্ছা করছে বুড়োটা বাঁচুক আরো ক'বছর। তাকে আগলাক।
চপের দোকানি বলল, যাও, মেয়েটা ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে।
সাইকেলের দোকানি বলল, ওহ্… টাকাটা নিই তো….
মেয়েটা বলল, তুইও মর।