Skip to main content

সে ভোরে উঠে বাজার ঝাঁট দেয়। তারপর বাসন মাজে। এর বাড়ি, ওর বাড়ি। বিকেলে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে। চায়ের দোকান বড় ছেলের। তার সঙ্গে কাজে হাত লাগায়। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়। দুটো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার পাশে কেউ শোয় না। তাকে জড়ায় না। তাকে আদর করে না। তার সিঁথি সাদা হতে হতে এখন হলদেটে। কালো চুলের মধ্যেই জন্মেছিল সাদা সিঁথি, এখন তো কত চুলে পাক। কে খেয়াল রাখে? ভোরে ওঠে। আবার যায় বাজারে। ঝাঁটা হাতে।

শিব মন্দিরের পাশে অনেক পুজোর ফুল জমে। বাসি ফুল। পাতা ফুল জমে গন্ধ ছড়ায়। ধূপের পোড়া কাঠি, দেশলাই, প্লাস্টিক, ভাঙা পুজোর ডালা…. আরো কত কি!

ঝাঁট দেওয়া শেষ। মন্দিরের চাতালে বসে চা খাচ্ছে। শিবুদা দোকান খুলে আঁচ দেয়। চায়ের জল চাপায়। তাকে এমনিই চা দেয়। পয়সা নেয় না।

শিবুদা বলল, এই জবা, শোন….

জবা চায়ের গ্লাস নিয়েই গেল। শিবুদা একটা সোনার আংটি ধুতিতে মুছে বলল, এটা দেখ… কাল মন্দিরে পেলাম। কার কে জানে!

জবা গ্লাসটা বেঞ্চে রেখে বলল, ও মা দাদা, পুলিশে যেতে হবে না? কি সুন্দর গো…. এ তো কোনো বাচ্চার…… দেখো….

জবার চোখে জল আসে বড় তাড়াতাড়ি। এত কান্না, উপচাবে না? মন অল্প টাল খেলেই জল গড়ায়। ভোরের সূর্যের প্রথম আলো জবার চোখের জলের উপর স্পর্শ রাখল।

শিবুদা বলল, এটা রাখ জবা…. কাউকে দেওয়ার দরকার নেই…..

জবা আংটিটা হাতে নিয়ে বলল, দাদা, এ আমি নিয়ে কি করব বলো? তুমি দাও, আমি বরং মন্দিরে দিয়ে আসি…. তিনি যা করবার করুন… ছোটোছেলেটাও যেদিন উনি ডেকে নিলেন সেদিন থেকে আমি আর কিছু চাই না দাদা…. এ সোনাদানা তো মাটি…. কি হবে? দাও… তুমিও রেখো না…..

শিবু জবার হাতে দিল। জবা জগের জলে হাতটা আর আংটিটা ধুয়ে মন্দিরের দিকে এগোলো। চারটে সিঁড়ি উঠেছে… পিছন থেকে শিবুদা ডাকল…. জবা…

জবা তাকালো ফিরে।

শিবুদা বলল, আমার নাতির…. মন্দিরে পাইনি…. ওর মা'টা তো পাগলের মত হয়েছে রে… এটা গিলে ফেলতে চায়….. আমি এ জিনিস কাছে রাখতে চাই না আর….

বস্তিতে আগুন লেগেছিল। সেই আগুনে যারা পুড়েছিল আর পুড়ে মরেছিল তাদের লিস্ট বেরিয়েওছিল। জবার বর, ছোটোছেলে, বড়ছেলের বউ, শিবুদার বউ, একমাত্র ছেলে, নাতি…. সব মরেছিল। শিবুদা বাড়ি ছিল না। মালদায় গিয়েছিল বোনের বাড়ি। আর জবার? ওই যে ওর বাঁ গালটা পোড়া… বাঁ হাতটাও..।

জবা আংটিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল খানিকক্ষণ। তারপর এক পা, এক পা করে নেমে এসে বেঞ্চে বসল। বলল, "আরেক কাপ চা দেবে দাদা? আমি রাখলাম এ আংটি আমার কাছে"…. তারপর শিবের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে, আবার মাথাটা নীচু করে বলল, "ওর কাছে দেব না… বড্ড হারিয়ে ফেলে সব…. ভুলো মন… বড্ড অগোছালো…. তোমার লাগলে তুমি চেয়ো… আমি দিয়ে দেব"......

শিবুদা চায়ের আরেকটা গ্লাস তার হাতে দিয়ে বলল, না দিলেও হবে। আমি জানি তোর কাছে থাকবে…. তুই অন্তত হারাবি না….