Skip to main content
 
মানুষ ঘেন্না করতে ভালোবাসে। যেমন ভালোবাসতে ভালোবাসে, তেমন বিদ্বেষ করতেও ভালোবাসে। এটা স্বাভাবিক। পছন্দের কথা না হলেও স্বাভাবিক।
       মসজিদের জনসমাগম এই পরিস্থিতিতে দুর্ভাগ্যজনক। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। যে এই জমায়েতের অনুমতি দিল সেও একই দোষে দুষ্ট। এই নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। সেই নিয়ে আলোচনা হল প্রচুর।
       হিন্দু বলতে চাইছে মুসলমান দায়িত্বজ্ঞানহীন, দেখ মসজিদে কি হল, দেখ তারা কোয়ারেন্টাইনে থেকেও অভব্য আচরণ করল, কারণ ওরা ওরকমই… ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদিকে মুসলমান বলছে হিন্দুরাও কম যায় না, এই বলে রামনবমীর জনসমাগম ইত্যাদির ছবি দিচ্ছে। আরেকদল দুই সম্প্রদায়েরই এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণকে সামনে তুলে ধরে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলতে চাইছেন।
       অর্থাৎ আমরা বাঁচি, কি মরি আমাদের আক্রোশ, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ধর্মের এদিকে কি ওদিকে পক্ষ নিয়ে, আর একপক্ষ দুই দিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ধর্মের দাগটাকে অন্তত এই জীবন মরণ সংকটের সময়েতেও ভোলা যাচ্ছে না, গুরুত্বহীন করা যাচ্ছে না।
       চিকিৎসক আপনার ধর্ম কি? নার্স আপনার ধর্ম কি? ঝাড়ুদার আপনার ধর্ম কি? ব্যাঙ্ককর্মী, পুলিশ আপনাদের ধর্ম কি?
       কেউ জিজ্ঞাসা করছি না। কারণ সে প্রশ্নের সাথে আমাদের স্বার্থ জড়িয়ে, সেখানে এই বিভাজন টানলে বেঘোরে মরতে হবে। অন্যদিকে সেই চিকিৎসক যদি আমার ভাড়াবাড়িতে থাকেন, বা নার্স থাকেন, তাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোটাও আমার কর্তব্য হয়ে উঠছে, কারণ ওই এক - স্বার্থ। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ।
       আমাদের বাকি অনেক জায়গায় অনেক খামতি, কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে না। আমাদের এই তর্জাটাতেই আমোদ। আমাদের এইভাবে ভাবতেই ভালো লাগে। আমরা বনাম তোমরা বানিয়ে এই অতিমারীর সময়েও ছু-কিৎ-কিৎ খেলতে ভালো লাগে। একটা আত্মপ্রসাদ পাই অন্যকে ছোটো প্রমাণ করে। অন্যের ভুল বিজ্ঞাপিত করে নিজেকে বড় প্রমাণ করতে, অন্যের দোষকে তাদের জাতীয় দোষ হিসাবে সাব্যস্ত করতে পারলেই আমাদের সমস্ত সিদ্ধি করতলাগত। এ যেন সেই বাড়ির বউ কিছুমাত্র ভুল করলেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার বাপের বাড়ির মানুষকে তুলে অসম্মান করা। সেই গ্রাম্যতাই আরো বড় ক্ষেত্রে।
       একজন মুসলমান ভুল আচরণ করলে কি হিন্দু ভুল আচরণ করলে আমি একজন ভারতীয় হিসাবে দুঃখ পাই, একজন ভারতীয়র দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ হিসাবেই তা দেখি। তাকে তার ধর্মের পরিচয়ে বিজ্ঞাপিত করে কোনো সংকীর্ণ আত্মগরিমা বা নির্লজ্জ 'তু তু ম্যায় ম্যায়' করতে লজ্জাবোধ হয়। নিজের সুপ্ত আক্রোশের সলতেতে আগুন জ্বালিয়ে ধর্মান্ধতার হাউইবাজী আকাশে উড়াতে রুচি যায় না।
       কারণ একটাই, আমার রক্তে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা, রামকৃষ্ণ, কবীর প্রমুখদের জীবনী আর বাণীর সম্পৃক্ততা। এ খেলা আর ভালো লাগে না। এ খেলা আজও টিকে আছে কারণ আমরা না হতে পেরেছি একটা রাষ্ট্র সত্য অর্থে, না হতে পেরেছি সেক্যুলার সত্য অর্থে। অথচ এই দেশের মাটি থেকেই বিশ্বনাগরিক হওয়ার ডাক এসেছিল প্রথম। যতদিন না এক সংবিধানে শ্রদ্ধা রাখা, আস্থা রাখা মানুষ হিসাবে নিজেদের চিনে নিতে পারছি ততদিন আমাদের ছুটি নেই এই মূর্খের স্বর্গ থেকে। মনের ভিতর থেকে বিদ্বেষ না গেলে সে সম্ভব নয়। বিদ্বেষ অন্যের চরিত্র বদলালে যায় না, নিজের বোধকে বিস্তৃত করলে যায়। এ সহজ হিসাব। যে বোঝে সে বোঝে, যে বোঝে না সে সোনার পাথরবাটির অপেক্ষায় সোনা আর পাথর দুইকেই ব্রাত্য করে, নিজের ক্ষীণ সংকীর্ণ দৃষ্টিকেই রাজপথ ভেবে চলে।